নিজ সবজিখেতে এমএ জাহাঙ্গীর

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণযোগযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এমএ জাহাঙ্গীর। করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সহপাঠী-বন্ধুরা যখন অলস সময় পার করছেন, তখন কৃষিকাজে মনোযোগী হয়ে দারুণ সফলতা পেয়েছেন তিনি। 

করোনাকালে সময় যেন কাটছিল না জাহাঙ্গীরের। তাই অবসর সময়কে কাজে লাগাতে সবজি চাষ শুরু করেন তিনি। শীতকালীন ফসল থেকে খরচ বাদে আয় করেছেন লক্ষাধিক টাকা। স্বল্প পরিসরে শুরু করলেও এখন সাতটি সবজি আইটেম নিয়ে কাজ করছেন। মোট চার বিঘা জমিতে টমেটো, শসা, করলা, ফুলকপি, চিচিঙ্গা, লাউ, পাটশাক ও লালশাকের চাষ করছেন। তার উৎপাদিত শাক-সবজি পরিবারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে স্থানীয় বাজারে।

জানা গেছে, অবসর সময়কে কাজে লাগাতে প্রথমে বাবার কৃষিকাজে সাহায্য করতেন জাহাঙ্গীর। বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করতে করতে এক সময় কৃষিকাজের প্রতি বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয় তার। তখন নিজেদের দুই বিঘা জমিতে ফসল ফলানো শুরু করেন। পরে ২০ হাজার টাকা দিয়ে এলাকার একজনের কাছ থেকে আরও দুই বিঘা জমি বর্গা নেন জাহাঙ্গীর। সেখানে সমন্বিত কৃষি উদ্যোগের মাধ্যমে শুরু করেন চাষাবাদ। ফসলের আগাছা দমন, বালাইনাশক প্রয়োগ, যত্ন নেওয়া, বাজারজাত করাসহ সব কাজ একাই করেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার সুখিয়া ইউনিয়নের সুখিয়া এলাকার আবির হাজী বাড়ির কৃষক ফরিদ উদ্দিন ও গৃহিণী আসমা খাতুনের চার ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় এমএ জাহাঙ্গীর। বড় ছেলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। তৃতীয় ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং চতুর্থ ছেলে জেএসসি পরীক্ষার্থী। 

জাহাঙ্গীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী যখন কৃষিকাজ করতে শুরু করে তখন গ্রামের অনেক মানুষই সেটা ভালো চোখে দেখে না। প্রথম প্রথম কৃষিকাজ করতে গিয়ে নানা মানুষের অনেক বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়েছে আমাকে। তবে এখন অনেকেই আমার কাজের প্রশংসা করছে। পড়াশোনা শেষ করেও কৃষিতে জড়িয়ে থাকার ইচ্ছা আছে। 

তিনি আরও বলেন, আমার এই কৃষিকাজের শুরু গত বছরের এপ্রিলের দিকে। প্রথমে বাবার কৃষিকাজে সময় দিতাম। পরে কৃষির প্রতি ভালো লাগা থেকেই শুরু। প্রথমে নিজেদের দুই বিঘা জমিতে চাষাবাদ শুরু করি। সেখানে ভালো করায় উৎসাহিত হয়ে পরে এলাকার একজনের কাছ থেকে আরও দুই বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ শুরু করি।

এবার শীতকালে দুই বিঘা জমিতে টমেটো, আর দুই বিঘা জমিতে ফুলকপির পাশাপাশি চিচিঙ্গা, লাউ, পাটশাক, লালশাকের আবাদ করি। শুরুতে টমেটোর ফলন খুব ভালো ছিল। প্রতিদিন প্রায় ১০-১২ মণ টমেটো বিক্রি করা যেত। পুরো সিজন জুড়ে প্রায় চার হাজার ফুলকপি বিক্রি করেছি। প্রতি পিস ফুলকপি ৫-২৫ টাকা ধরে বিক্রি হয়েছে। ফুলকপি শেষে সেই জমিতে শসা আর করলা চাষ করেছি। শসার ফলন দেওয়া শুরু হয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে ভালো মুনাফা আসবে শসা থেকে।

জাহাঙ্গীর বলেন, এই করোনা মহামারিতে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। ঠিক যেন একজন সফল কৃষক হয়ে গেছি। একজন কৃষক যেমন বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে, সেগুলো মোকাবেলা করে সফলতা পেয়েছি। কৃষি কাজ করে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ টাকা লাভ হয়েছে। আরও লাভ হবে বলে আশা করছি। 

তিনি আরও বলেন, একবিঘা জমিতে ফসল আসা পর্যন্ত যদি খরচ হিসেব করা হয় তাহলে ২৫-৩০ হাজারের মতো খরচ হয়েছে। সবজি উত্তোলন থেকে সেটা বাজারজাত করা পর্যন্ত সব কাজগুলো একাই করেছি। শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় চাষে খরচ অনেক কমে গেছে। যেদিন সবজির পরিমাণ কম থাকে সেদিন সাইকেলে চেপে বাজারে নিয়ে যাই। আর যেদিন পরিমাণে বেশি থাকে সেদিন গাড়ি ভাড়া করে বাজারে সবজি নিয়ে যেতে হয়।

আক্ষেপ নিয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, কৃষি মানে হচ্ছে মাটির সাথে বন্ধুত্ব করে বেঁচে থাকা। সেটা কতটা কঠিন তা শুধু একজন কৃষকই বুঝতে পারেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্ট করে কৃষক জমিতে ফসল ফলান অথচ তাদেরকে সমাজের নিম্ন শ্রেণির মানুষ মনে করা হয়। দেশের কৃষকরা তাদের যথেষ্ট সম্মানটুকুও পান না। কত কষ্ট করে যে একজন কৃষক ফসল ফলান কৃষিকাজ না করলে কেউ বুঝতে পারবেন না।

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরের ‘সমন্বিত কৃষি উদ্যোগ’ পরিদর্শন করেছেন সুখিয়া ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আফাজ উদ্দিন। জানতে চাইলে আফাজ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি তার (জাহাঙ্গীর) প্রায় চার বিঘা কৃষি খামার ঘুরে দেখেছি। সেখানে তার বিভিন্ন ধরণের সবজিখেত আমি পরিদর্শন করেছি। পরিকল্পিতভাবে চাষ করায় ভালো ফলন দেখা গেছে। সবজি চাষে তার অগ্রগতি দেখা গেছে। জাহাঙ্গীরের কৃষিকাজে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন এই কৃষি কর্মকর্তা।

আরএআর