ফরিদপুরে ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে ইটভাটায় নেয়া হয়

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলায় ফসলি জমিতে পুকুর কাটা হচ্ছে, সেই মাটি যাচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়। উপজেলার চালিনগর গ্রামের আলমগীর হোসেন এসব মাটি ইটভাটায় বিক্রি করেছেন। চালিনগর মাঠে নিজের ১৮০ শতক ফসলি জমির মাটি বিক্রি করে পুকুর কাটাচ্ছেন তিনি। ছোলনা গ্রামের মাটি ব্যবসায়ী সাহেব আলী এ জমির মাটি কিনে স্থানীয় ইটভাটাসহ বিভিন্নজনের কাছে বিক্রি করছেন। 

সরেজমিনে দেখা যায়, ভেকু মেশিন দিয়ে একপাশ থেকে মাটি কেটে পাড়ি বাঁধা শুরু হয়েছে। এসব মাটি ট্রাকভর্তি করে ইটভাটায় নিয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকরা।

মাটিকাটা তদারকি করতে থাকা সাহেব আলীর ছেলে হাসান বলেন, মাসিক এক লাখ ৮০ হাজার টাকায় ভেকু মেশিন ঠিক করা হয়েছে। ভেকুর তেল খরচও আমাদের দিতে হয়। 

এ সময় জমির মালিক আলমগীর হোসেন বলেন, চার পাশে পাড়ি বেঁধে দিয়ে মাটি নিয়ে যাবে। টাকা-পয়সার কোনো ব্যাপার নেই এখানে। 

মাটি ক্রেতা সাহেব আলী বলেন, অল্প পরিমাণ টাকা জমির মালিককে দিতে হবে। তবে টাকার নির্দিষ্ট পরিমাণ বলা যাবে না।

অপরদিকে সাতৈর ইউনিয়নের জয়নগর মাঠের জমি থেকে ভেকু দিয়ে মাটি কেটে পাঠানো হচ্ছে পাশের আরেক ইটভাটায়। দুটি ড্রেজার বসিয়ে একই জায়গার পুকুর থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে মাটি। এ জমির মালিক হিরু মুন্সী প্রথমে বিষয়টি স্বীকার করতে চাননি।

পরে অবশ্য হিরু মুন্সী বলেন, জমি থেকে কিছু মাটি কারখানার ভেতর নিয়েছি; কিছু মাটি লেলিনের ভাটায় বিক্রি করেছি। শুধু চালিনগর বা জয়নগর মাঠ নয়, উপজেলার বিভিন্ন মাঠ থেকে ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় নেওয়া হচ্ছে। 

নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা কৃষি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করছেন। কখনও কখনও ভাটা মালিক ও ব্যবসায়ীরা প্রলোভন দেখিয়ে কৃষি জমির মাটি বিক্রি করতে উৎসাহিত করছেন জমির মালিকদের। বিশেষ করে উপজেলার দুটি অটোভাটা শেখর ইউনয়নের ভাটপাড়ার আল আলী অটো ব্রিকস ও সাতৈরের ন্যাশনাল অটো ব্রিকসে মাটির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। 

শেখর গ্রামের কৃষক শাহজাহান বলেন, অটোভাটা যেভাবে ফসলি জমির মাটি নিয়ে যাচ্ছে তাতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মাঠ সব পুকুর হয়ে যাবে। 

হিরু মুন্সীও বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এভাবে মাটি কাটা হলে ফসলি জমি আর থাকবে না। সবাই মাটি বিক্রি করে দিচ্ছে।  

ফসলি জমি থেকে মাটিকাটার ফলে উপজেলায় কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইটভাটা স্থাপন ও কৃষি জমি রক্ষার জন্য আইন থাকলেও তা কেউ মানছে না। 

২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে কৃষি জমি, বা পাহাড় বা টিলা হতে মাটি কেটে বা সংগ্রহ করে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে মৌজা পুকুর বা বিল বা খাঁড়ি বা দিঘি বা নদ-নদী বা হাওর-বাঁওড় বা চরাঞ্চল বা পতিত জায়গা হতে মাটি কাটতে পারবে না।

উপজেলায় দুটি অটো ব্রিকসহ ১৭ ইটভাটা রয়েছে। ১৭ ইটভাটায় ইট তৈরিতে প্রতিদিন কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে হাজার হাজার ঘনফুট মাটি। এই মাটির সবটুকু জোগান দিচ্ছে ফসলি জমি। সকাল হতেই মাটি আনতে মাঠে ছুটে যায় ভাটার নিজস্ব লোকজন আর ঠিকাদারদের ট্রলি। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভাটা মালিক বলেন, অধিকাংশ ভাটা মালিকই এখন কৃষি জমি থেকে মাটি নিচ্ছেন। এর বাইরে মাটির কোনো উৎস এখানে নেই। 

ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি শ্যামল কুমার সাহা বলেন, কৃষি জমি থেকে মাটি নেওয়া বেআইনি। মরা খাল, মৌজা পুকুর থেকে নেওয়া যেতে পারে। এবারে প্রকৃতি খুবই বিরূপ। বৃষ্টি, কুয়াশা, করোনা, তার ওপর সরকার ইটকাটার লাইসেন্স দিয়েছে; কিন্তু মাটি কাটা বন্ধ করে দিয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, মাটিকাটার অনুমতি চেয়ে ভাটা মালিক সমিতি জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছে। এর আগে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে এক সভায় প্রস্তাব দিয়েছিলাম বারাশিয়া নদী থেকে মাটিকাটার অনুমতিদানের জন্য। সরকার অনুমতি দিলে নিয়ম-নীতি মেনে নদী থেকে মাটি কাটলে তিন পক্ষের লাভ। সরকারের টাকা খরচ করে নদী কাটা লাগবে না; বরং রাজস্ব পাবে, ভাটা মালিকদের লাভ তারা মাটি পাবে, জনগণের লাভ মাছ আর নদী পথ ব্যবহারের সুযোগ পাবে।

বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঝোটন চন্দ জানান, জমির উপরিভাগ চাষবাস করার জন্য জনগণ ব্যবহার করতে পারবে। সরকারকে ভূমি কর দেওয়ার মাধ্যমে জমির মালিক এ অধিকার অর্জন করে। কিন্তু নিচের অংশ সরকারের। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রন) আইন অনুযায়ী ফসলি জমির মাটি ইটভাটায় ব্যবহার করা যাবে না। 

তিনি আরও বলেন, ফসলি জমিতে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। এজন্য কোথাও মাটিকাটার খবর পেলে বন্ধ করে দেই। ইতোমধ্যে দুটি ইটভাটাকে জরিমানা করেছি। তবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের (জেলা প্রশাসক) অনুমতি সাপেক্ষে ভাটা মালিকরা মাটি কাটতে পারবে। এজন্য ইটভাটা মালিক সমিতি ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন।

এএম