স্বামী মারা যাওয়ার শোক সইতে না পেরে একপ্রকার পাগলের মতো হয়ে যান খাতুন নেছা। একদিন হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। ১৪ বছর পর পাওয়া যায় তাকে। তারপর ওঠেন মেয়ের কাছে। মেয়ের সংসারে এমনিতেই অভাব-অনটন। তারপরও গর্ভধারিণী মাকে বাঁচাতে ভিক্ষা করে এনে খাওয়ান। আর যেদিন কিছু না জোটে, সেদিন থাকেন অনাহারে। একমাত্র ছেলেও মাকে ছেড়ে চলে যান বিদেশে। বার্ধক্যের কারণে এখন হাঁটতে পারেন না খাতুন নেছা। জায়গা হয়েছে একটি ঝুপড়ি ঘরে। বৃষ্টি এলে ঘরে পানি ঢুকে হয়ে যায় স্যাঁতসেঁতে। সরকারি কোনো সহযোগিতা পান না।

ডামুড্যা উপজেলার পূর্ব ডামুড্যা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা খাতুন নেছার বয়স ১০০ ছুঁইছুঁই। তার স্বামী আলী আহমেদ মারা যান ২৫ বছর আগে। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে।

জানা যায়, স্বামী মারা যাওয়ার পর যখন নিখোঁজ হন খাতুন নেছা। এদিকে তার ছেলে সব সম্পত্তি বিক্রি করে পাড়ি জমিয়েছেন পাকিস্তানে। মায়ের সঙ্গে রাখেন না কোনো যোগাযোগ। তাই যখন তাকে উদ্ধার করে আনা হয়, তখন একমাত্র মেয়ের কাছে হয় তার আশ্রয়। এদিকে ৭২ বছর বয়সী মেয়ে সাহার বানুর সংসারেও অভাব। তাই মাকে নিয়ে চলছে তারও নিদারুণ কষ্ট।

খাতুন নেছা এক বছর বয়স্ক ভাতা পেলেও জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় এখন আর তা-ও পাচ্ছেন না। বার্ধক্যের কারণে হাতের আঙুলের রেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। তাই আঙুলের চাপ না দিতে পারায় করতে পারছেন না জাতীয় পরিচয়পত্র। আর জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় মিলছে না ভাতা।

এলাকাবাসী জানান, খাতুন নেছা তার স্বামী মারা যাওয়ার পর পাগল হয়ে যান। তাকে ঘরে আটকে রাখা হতো। সুযোগ পেলেই ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যান। আবার ফিরে আসতেন। এর আগে দীর্ঘ ১৪ বছর নিখোঁজ ছিলেন। পরে পটুয়াখালীর রাঙাবালী থেকে সাংবাদিকরা তাকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে দিয়ে যান। তখন সরকারি একটি বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করে দিলেও এখন তা আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সাহার বানুর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, আমার বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। মা পাগল হইয়া যায়। বিভিন্ন সময় তাকে ঘরে আটকে রাখতাম। হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হইয়া যায় মা। অনেক খোঁজাখুঁজি করে পরে মাকে ফিরে পাই। এরপর থেকে মা আমার কাছেই থাকে। পরে সরকার বিধবা ভাতার কার্ড করে দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর স্থানীয় মেম্বার তা নিয়া যায়। এখন আর কিছুই পায় না। ভোটার কার্ড (জাতীয় পরিচয়পত্র) করার জন্য চেষ্টা করেছি। মা বয়স্ক বিধায় আঙুলের ছাপ উডে না। তাই করা যায় না।

সাহার বানু স্বামী অসুস্থ। কাজ করতে পারেন না। ছোট একটি ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন সাহার বানুর ছেলের বউরা। সাহার বানুর ছেলেরা যা দেন, তা দিয়ে চলে তার সংসার। সরকারিভাবে কোনো ধরনের সহযোগিতা পান না। এমনটা জানিয়ে সাহার বানু বলেন, আমার স্বামী একটা ভাতার কার্ড পাইছে। আমার মা অনেক সময় অসুস্থ হইয়া পড়ে। তখন ঘরে প্রস্রাব-পায়খানা করেন। টাকার জন্য চিকিৎসা করতে পারি না। তাই মাকে ছোট ঘরে (লাকড়ি রাখার ঘর) রাখি। মাঝেমধ্যে আমি তার সঙ্গে ছোট ঘরে ঘুমাই। আমার বয়স হইছে। আর পারি না।

সাহার বানু বলেন, মাকে নিয়ে অনেকটা অসহায়ভাবে জীবন যাপন করতাছি। ভিক্ষা কইরা মাকে খাওয়াই। এ-ওর থেকে চাইয়া কাপড় আনছি। সেই কাপড় আমার মাকে পরাইছি। এখন দুইটা কাপড় দিয়েই জীবনটা পার করছে মা। কারও কাছে যাইও না, চাইও না। সরকারি কোনো কিছুই পাই না। এক মুঠো চাউলও কেউ দেয় না।

সাহার বানু প্রতিবেশী ময়না বেগম বলেন, খাতুন নেছার শুধু এই মেয়ে ছাড়া কেউ নেই। কষ্ট করে থাকে। ছেলে বহু বছর আগে পাকিস্তান চলে যায়। অনেক জায়গা জমিন ছিল খাতুন নেছার স্বামী আলী আহমেদের। কিন্তু ছেলে সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়। এখন বড় কষ্টে ঝুপড়ি ঘরে থাকেন তিনি। তার জন্য যদি একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেয় সরকার, খুব ভালো হতো।

পূর্ব ডামুড্যা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল মেম্বার আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা আগে জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা দিয়ে থাকতাম। এখন জন্মনিবন্ধনে বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা দেওয়া যায় না। খাতুন নেছাকে তিন বছর আগে জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হয়েছিল।

তিনি বলেন, অনলাইন করার কারণে তার বই নিয়ে উপজেলা জমা দেওয়া হয়। তবে এখন আর জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া করা কোনো ভাতার ব্যবস্থা করা যায় না বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে ডামুড্যা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারি বয়স্ক ও বিধবা ভাতা নিতে হলে অবশ্যই তার জাতীয় পরিচয়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক। এটা না হলে এখন আর অনলাইন করা সম্ভব নয়। এতে তাকে আমরা কোনো ধরনের সুযোগ প্রদান করতে পারছি না।

এনএ