‘নদীতে দুই মাসের অভিযান ছিল। তখন আমরা মাছ ধরি নাই। এখন নদীতে যাই। কিন্তু মাছ পাই না। এমনকি মাছ ধরার খরচের টাকাও ওঠে না। এখন মাছের আশায় সাগরে যামু। তাও দিছে আবার দুই মাসের অভিযান। এই অভিযানে অভিযানেই আমাগো জীবন শ্যাষ। মাছ আর আমগো কপালে থাহে না। এখন কিস্তির টাকা দিমু কেমনে? বউ-পোলাপান লইয়া চলমুইবা কেমনে তার চিন্তায় বাঁচি না। সরকার যা আমাগো লাইগা বরাদ্দ দেয়, তা সব ওপরের মানুষেরা খাইয়া ফালায়।’

ক্ষোভ ও আক্ষেপের সঙ্গে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ভোলার দৌলতখান উপজেলার চৌকিঘাট এলাকার জেলে রফিক মাঝি।

করোনা দুর্যোগের মধ্যেও মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাগরে ৬৫ দিনের জন্য মাছ ধরা বন্ধ থাকায় রফিক মাঝির মতো বেকার হয়ে চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন ভোলার ৬৩ হাজার জেলে। মাছ ধরা বন্ধ থাকায় অভাব-অনাটন আর সংকটের মধ্যে পড়েছেন তারা।

মার্চ-এপ্রিল দুই মাস বিভিন্ন নদীর অভয়াশ্রমগুলোতে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার তিন সপ্তাহ পর ফের সাগরে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় হতাশ ভোলার সমুদ্রগামী জেলেরা। তাদের মতে- মৌসুম না আসায় মে-জুনে নদীতে এমনিতেই ইলিশ থাকে না। এ সময় সমুদ্র এলাকায় কিছু ইলিশ পাওয়া যায়। কিন্তু নদীতে দুই মাস মাছ ধরতে  না পারায় যে ক্ষতির কবলে পড়েছেন জেলেরা তার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগ মুহূর্তে সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার এমন নির্দেশকে তারা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মনে করছেন।
 
সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ভোলার দৌলতখানের সফিজল মাঝি বলেন, এমন নিষেধাজ্ঞা থাকলে নৌকা, জাল, জ্বালানি ও শ্রমিকদের ব্যয় নির্বাহ করে এ পেশায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। ৬৫ দিনের এই অভিযানে আমরা অভাব-অনটন আর সংকটের মধ্যে পড়েছি। কেউ ধারদেনা করে দিন কাটাবেন কেউবা বিকল্প পেশা খুঁজছেন। কষ্টে দিন কাটাতে হবে আমাদের। এ অবস্থায় সরকারের বরাদ্দ আরও বাড়ানোর দাবি জানান তিনি। এছাড়া তাদের জন্য বরাদ্দকৃত প্রণোদনা প্রকৃত জেলেদের মাঝে সঠিক সময়ে বিতরণের দাবিও করেন সফিজল মাঝি।

দৌলতখানের মৎস্য ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, গত বছর করোনার কারণে ২৭ লাখ টাকা লোকসান দিছি। মাছ কিনে পার্টির কাছে কম দামে বিক্রি করতে হইছে। এ বছর আশা করছি মাছের সিজনে ব্যবসা করব। কিন্তু দুই মাসের অভিযানে জেলেরা মাছ ধরতে পারেননি। নদীতেও এখন মাছ নেই। সাগরে যারা মাছ ধরেন তাদের দিকে আমাদের তাকিয়ে থাকতে হয়। জেলেরা মাছ ধরে আনবেন। সেই মাছ বিক্রি করে আমরা দেনা-পাওনা পরিশোধ করব। 

কিন্তু সাগরেও এখন অভিযান দিছে। আমাদের দেশের জেলেরা তো সব অভিযান মানে কিন্তু এই সময় বাংলাদেশের জলসীমায় নির্বিচারে মাছ ধরেন ভারতীয় জেলেরা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি মৎস্য ব্যবসায়ীদের এ সময় সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার দাবি জানান। 

এছাড়াও নিষেধাজ্ঞার শুরুর দিকে যথাযথ সহায়তা না পেলে বাধ্য হয়ে অনেককেই সাগরে মাছ ধরতে হবে বলে জানিয়েছেন জেলেরা।

ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম আজাহারুল ইসলাম জানান, মাছের প্রজনন ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইলিশসহ সকল প্রজাতির মাছ ধরার ওপর বুধবার (১৯ মে) মধ্যরাত থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা থাকবে। গত দুই বছর এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হওয়ায় গেল বছর ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। ফলে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে মৎস্য বিভাগ আরও গুরুত্বসহকারে কাজ করছে। এ সময় মাছ ধরা থেকে বিরত থাকা জেলেরা যাতে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন সেজন্য ভোলার ৬৩ হাজার ৯৫৪ জন সমুদ্রগমী জেলের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং যথাসময়ে প্রণোদনার চাল বিতরণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এছাড়াও সাগরে ভারতীয় জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ রাখতে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সম্মিলিত পদক্ষেপ থাকবে। যাতে অবৈধভাবে কেউ মাছ ধরতে না পারে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সাগরে মাছ ধরতে গেলে জেলেদেরকে কারাদণ্ড কিংবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

উল্লেখ্য, মার্চ-এপ্রিল দুই মাসে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় ভোলা জেলার ৭ উপজেলায় ১৬৪ জন জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ৩৩০ জন জেলেকে প্রায় ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর/জেএস