রাজকুমারের অন্ধকার জীবন
অন্ধ বংশীবাদক রাজকুমার
রাজকুমার। নামে রাজকুমার হলেও বাস্তবে তা নয়। বাপ-দাদার রাজত্ব নেই। নেই গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান আর ক্ষেতের পর ক্ষেত। শুধু আছে অভাব-অনটন আর জীবন যুদ্ধে ঠিকে থাকার সুর। অথচ শৈশব থেকে টগবগে কৈশোরে রাজকুমারের একটা রাজপ্রাসাদ ছিল। দুচোখ জুড়ে ছিল আলোময় পৃথিবী।
বন্ধুদের সঙ্গে বই খাতা হাতে স্কুলে যাওয়া-আসা। সকাল বিকেল হৈ-হুল্লোড় আর দুরন্তপণাই ছিল রাজকুমারের রাজত্বে। হঠাৎ করেই সেই সুন্দর জীবনে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায় দুচোখ। আশির দশকে অন্ধকারের রাজত্বে নিমজ্জিত হয় রাজকুমারের জীবন। চিরদিনের মতো চোখের আলো হারান তিনি।
বিজ্ঞাপন
অন্ধ হয়ে বন্ধ হয়ে যায় রাজকুমারের রাজপ্রাসাদের দরজা। কিন্তু ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারেও জীবন যুদ্ধ থামেনি তার। হাতে তুলে নেন বাঁশের বাঁশি। গ্রামে-শহরে ঘুরে ঘুরে বাঁশির সুর ছড়িয়ে সংসার চালাতে শুরু করেন। সেই থেকেই বাঁশি বাজিয়ে জীবন পাড়ি দিচ্ছেন সংগ্রামী বংশীবাদক রাজকুমার।
প্রায় ৪০ বছর ধরে বাঁশি বাজিয়ে সংসার চালানো রাজকুমার থাকেন রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাইম পীরজাবাদ এলাকার ডাক্তারপাড়ায়। স্ত্রী কনিকা রানী আর দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়েই এখন রাজকুমারের সংসার। গরু-ছাগল লালন পালনের পাশাপাশি বাঁশের বাঁশির সুরে ভরসা করে দিন কাটছে তার।
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারি) দুপুরে রংপুর নগরের স্টেশন রোডে দৈনিক দাবানল মোড়ে দেখা মেলে বংশীবাদক রাজকুমারের। আপন মনে বাঁশি বাজিয়ে হেঁটে চলেছেন তিনি। বুকে ঝুলানো কাগজে লেখা - ‘আমি অন্ধ রাজকুমার। বাঁশি বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। আমাকে সাহায্য করুন’। তার এই সাহায্য প্রার্থনা আর বাঁশির সুরে মুগ্ধ মানুষেরা হাত বাড়িয়ে যা দেন তাই জীবিকার অংশ।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে রাজকুমার জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্টে ঘেরাও করতে তীর-ধনুক, লাঠিসোটা নিয়ে তিনি ও তার চাচাতো ভাই গিয়েছিলেন। তখন বয়স ১৫ বছরের কম। সেই দিন পাকিস্তান বাহিনীর কামান আর মেশিন গানের গুলিতে তিনি আহত হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর অজানা এক রোগ দেখা দেয় তার দুচোখে। এ সময় অভাবের সংসারে চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম খান তার বাবা মনিন্দ্র রায়। পরিবারে মাসহ চার ভাই ও এক বোনকে নিয়ে কষ্টে চলছিল তাদের সংসার। এ কারণে চোখের চিকিৎসা করাতে পারেননি।
তিনি বলেন, নানান গজবে দাদা আমার জীবনটা নষ্ট। আমার বাবা বেশি শিক্ষিত ছিলেন না। রোকেয়া কলেজের মালি ছিলেন। চাচা মলয় বাবু ছিলেন প্রফেসর। এক চাচাকে যুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনী মেরে ফেলেছে। আমার বংশটাতে সবার অবস্থা ভালো। কিন্তু কাজের বেলায় কেউ আমাকে হেল্প করে নাই।
আক্ষেপ করে ৬৫ বছর বয়সী রাজকুমার বলেন, কোনো উপায় নেই। এভাবেই আমার বাকি জীবনটা চলে যাবে। অনেক টাকাতো খরচ করছি। কিন্তু চোখের রোগ সারাতে পারিনি। ডাক্তারের পরামর্শ ছিল বাইরে উন্নত চিকিৎসা করার। টাকা-পয়সার অভাব আর বাবার অনীহার কারণে ঠিকমতো চিকিৎসা হয় নাই। এ কারণে আজকে আমি চোখ থাকতেও অন্ধ।
পরিবারের আর্থিক অভাব অটনের কারণে নিজে পড়ালেখা করতে পারেননি। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় শেষ হয় তার প্রাইমারির গণ্ডি। আর কখনও বই খাতা হাতে বন্ধুদের সঙ্গে স্কুল যাওয়া হয়নি। তবে নিজে পড়ালেখা করতে না পারলেও ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছেন রাজকুমার। তার বড় ছেলে জয়ন্ত কুমার রায় উচ্চ মাধ্যমিকে আর ছোট মেয়ে পড়ছে অষ্টম শ্রেণিতে।
রাজকুমার বলেন, যুদ্ধের পর থেকে আমার চোখের সমস্যা শুরু হয়। বাবা ঠিক মতো ট্রিটমেন্ট করতে পারেন নাই। এভাবেই আমার চোখ দুটো নষ্ট হয়ে যায়। আমার মা নেই। ছোটবেলা থেকেই আমি মা হারা। বাবা আরেকটা বিয়ে করেন। পরে বাবাও মারা যান। এখন আমার বিধবা মা বেঁচে আছেন। আমি আমার দুই বাচ্চা আর বউকে সঙ্গে নিয়ে কোনো রকমে আছি।
সংসার চালাতে গত ৪০ বছর ধরে রংপুরের পাড়া মহল্লার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাজকুমার। বাঁশির সুরে আকৃষ্ট করা এই রাজকুমারকে নগরীর বেশির ভাগ মানুষ চেনেন। দৃষ্টিহীন হলেও রাজকুমার রংপুরের পথঘাট সম্পর্কে সব কিছু জানেন। সপ্তাহে ছয়দিন তিনি রংপুর নগরীর বাস টার্মিনাল, কামারপাড়া কোচ স্ট্যান্ড, ধাপ মেডিকেল মোড়, লালকুঠির মোড়, সেন্ট্রাল রোড, লালবাগ, মুন্সিপাড়া, জুম্মাপাড়া, সুপার মার্কেট, কাচারীবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে বাঁশি বাজিয়ে মানুষকে আনন্দিত করেন। বিনিময়ে কখনও দিনে ২০০ টাকা আবার কোনো কোনো দিন ২৫০ থেকে ৪০০ টাকাও বকশিস জোটে তার বাঁশির সুরে। যা উপার্জন হয় তাই দিয়ে কষ্ট করে চলে সংসার।
সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ব্যাপারে রাজকুমার বলেন, রমজান মাসে সাড়ে ৪ হাজার টাকা পেয়েছি। দুই কিস্তির টাকা একসঙ্গে দিয়েছিল। এরপর থেকে আর পাইনি। সরকারিভাবে তিন মাস পরপর প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়। কিন্তু এ টাকায় তার সংসার চলে না। এজন্য বাঁশি বাজিয়ে কিছু উপার্জনের পাশাপাশি বাড়িতে দুই একটা গরু ছাগল পালন করছি।
বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগে না। তাই সকাল হলেই হাতে চারটা বাঁশি আর একটা লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন রাজকুমার। বাড়ি থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চড়ে শহরের দিকে এসে বিভিন্ন এলাকায় হেঁটে হেঁটে বাঁশি বাজান। সন্ধ্যা হলেই যা উপার্জন হয়, তাই নিয়ে ঘরে ফেরেন।
আরএআর