নাটোরের লালপুর উপজেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলামকে স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) মো. শহিদুল ইসলাম বকুলের বাড়িতে ডেকে নিয়ে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তার কাছ থেকে দাবিকৃত পাওনা বাবদ ৮ লাখ টাকার জন্য দলিলে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বৃহস্পতিবার (২৪ জুন) দুপুর ২টার দিকে বাগাতিপাড়া উপজেলার স্যান্যালপাড়া গ্রামে নাটোর-১ (লালপুর ও বাগাতিপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুলের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রাতে লালপুর উপজেলার গোপালপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোকনুজ্জামান রোকন ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা বাগাতিপাড়া থানায় মামলা করেছেন।

মামলার পর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ অভিযুক্ত মো. রাসেল আহমেদ (৩৮) ও মো. আবুল কালাম আজাদ (৩৭) নামে দুজনকে গ্রেফতার করেছে। তবে অপর আসামি রোকনুজ্জামান পলাতক রয়েছেন। আটক রাসেল লালপুর উপজেলার নেংগপাড়া গ্রামের হাসান মন্ডলের ছেলে এবং আবুল কালাম বিজয়পুর গ্রামের জামাল উদ্দিনের ছেলে। তারা দুইজনই গোপালপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোকনুজ্জামান রোকনের সহযোগী বলে জানা গেছে।

এদিকে এ ঘটনায় উপজেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম প্রথমে লালপুর থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু ঘটনাস্থল বাগাতিপাড়া এলাকায় হওয়ায় মামলা গ্রহণ না করে বাগাতিপাড়া থানায় যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তাকে ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। পরে তিনি বাগাতিপাড়া থানায় মামলা করেন। 

লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফজলুর রহমান জানান, ঘটনাটি বাগাতিপাড়া উপজেলা এলাকায় উল্লেখ রয়েছে। তাই বাদীকে বাগাতিপাড়া থানায় তার অভিযোগ দাখিল করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

লালপুর উপজেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন, বৃহস্পতিবার (২৪ জুন) দুপুর ২টার দিকে স্থানীয় এমপি শহিদুল ইসলাম বকুল সমর্থিত গোপালপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এমপির ঠিকাদারী ব্যবসার পার্টনার রোকনুজ্জামান রোকন ফোন করে তাকে এমপির বাড়িতে যেতে বলেন। রোকনের ফোন পেয়ে তিনি বাগাতিপাড়া উপজেলায় এমপির বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হন। এ সময় সেখানে উপস্থিত গোপালপুর পৌর আওয়ামী লীগ নেতা ও ঠিকাদার রোকনুজ্জামান রোকন এবং তার দুই সহযোগী রাসেল আহমেদ ও আবুল কালাম তাকে এমপির বসার ঘরে নিয়ে যান। এ সময় এমপি শহিদুল ইসলাম বকুল তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন এবং খাদ্যগুদামে গম সংগ্রহ বিষয়ে জানতে চেয়ে কয়েক মিনিট কথা বলে চলে যান। 

এমপি বকুল চলে যাওয়ার পর পরই রোকনুজ্জামান রোকনসহ তার সহযোগীরা তার কাছে ২০ লাখ টাকা দাবি করে বসেন। এ সময় তারা তাকে বলেন, খাদ্যগুদাম কর্মকতার পদ অনেক লাভজনক। এক বছর ধরে আছেন অথচ আমাদের সঙ্গে একদিনও দেখা করেননি। দলীয় কাজে তাদের ২০ লাখ টাকা দিতে হবে বলে দাবি করেন। টাকা দিতে অস্বীকার করলে তার ওপর শুরু হয় মানসিক নির্যাতনসহ কিল-ঘুষি। প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা ওই ঘরে বসিয়ে রাখা হয় তাকে।

তিনি জানান, একপর্যায়ে রাসেল তার কাছে ৮ লাখ টাকা পাবেন বলে দাবি করে বসেন। টাকা দিলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে নইলে ছাড়া হবে না এমন হুমকি দিতে থাকেন। একই সঙ্গে চলতে থাকে কিল-ঘুষিও। পরে তারা ঘর থেকে বের করে রাস্তায় এগিয়ে দেওয়ার কথা বলে তাদের দাবিকৃত পাওনা বাবদ ৮ লাখ টাকার জন্য দলিলে তার কাছ থেকে জোর করে স্বাক্ষর নেন। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করে লালপুর থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। 

পরে লালপুর থানার ওসির পরামর্শ ও সহযোগতিায় রাতেই বাগাতিপাড়া থানায় এসে এজাহার দাখিল করেন। এদিকে ওই ঘটনার পর রাতেই নাটোর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল রাসেল আহমেদ ও আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতার করেন। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি শফিকুল ইসলাম দুজনকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 

অপরদিকে বাগাতিপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি) মামলার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, এ ঘটনায় দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্ত সাপেক্ষে এ ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা ও ঠিকাদার রোকনুজ্জামান রোকনের মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলো তা বন্ধ পাওয়া যায়। 

নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নাটোর-১ (লালপুর ও বাগাতিপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুল জানান, তার বাসায় বা বৈঠকখানায় কাউকে মারপিট বা আটক রাখার কোনো ঘটনা ঘটেনি। বিষয়টি সাজানো। 

তিনি বলেন, লালপুর উপজেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা নিজেই তার প্রয়োজনে আমার কাছে এসেছিলেন। খাদ্যগুদামে গম সংগ্রহ বিষয়ে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে সে বিষয়ে তিনি আমার সহায়তার জন্য এসেছিলেন। তার সঙ্গে আমি মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট কথা বলে চলে যাই। তাকে কেউ ডেকে আনেননি বা আমার বাড়িতে দীর্ঘ সময় আটকে রাখার বিষয়টিও সঠিক নয়। 

শহিদুল ইসলাম বকুল বলেন, প্রতিপক্ষ আমার সুনাম ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যে এমন নাটক সাজাতে খাদ্যগুদাম কর্মকর্তাকে আমার বাসায় পাঠিয়েছে। ওই খাদ্য কর্মকর্তাও আমাকে বিষয়টি জানাতে পারতেন। তিনি সেটি না করে মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন। বিষয়টি তদন্ত করে ঘটনার প্রকৃত তথ্য উদঘাটনের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন এই সংসদ সদস্য। 

তাপস কুমার/আরএআর