স্বাদে অনন্য লালি
লালি তৈরির জন্য আখের রস জ্বাল দেয়া হচ্ছে
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে এখন চলছে শীতকাল। আর এই শীতের সকালে উষ্ণতা ছেড়ে খেঁজুরের রসের ঘ্রাণ নেয় নানা বয়সের মানুষ। এক গ্লাস টাটকা খেঁজুরের রসে সকালটা হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ। তবে হিম জড়ানো শীতের আরেক অনুষঙ্গ আখের রসে তৈরি লালি। এই লালি দিয়ে তৈরি পিঠু-পুলির অনন্য স্বাদ শীতের আমেজকে ভিন্ন মাত্রা দেয়।
চলতি শীত মৌসুমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রায় ৬শ মেট্রিক টন লালি বিক্রি হবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। যার বাজার মূল্য অন্তত ৪ কোটি টাকা।
বিজ্ঞাপন
লালি মূলত আখের রসে তৈরি এক ধরনের তরল গুড়। মুখরোচক এই তরল গুড় পিঠা-পুলি ও পায়েস তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া চিড়া-মুড়ির সঙ্গে খেতেও অনন্য এই লালি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিন উপজেলায় প্রতি শীত মৌসুমেই লালি তৈরি করেন স্থানীয় কৃষি পরিবারগুলো। বছরের চার মাস লালি তৈরি করে বাড়তি টাকা আয় করেন তারা।
লালি তৈরি ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত আখের মৌসুম ধরা হয়। আর এই সময়টাতেই জেঁকে বসে শীত। এর ফলে এই চার মাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর, কসবা ও বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় উৎপাদিত আখ থেকে লালি তৈরি করেন স্থানীয়রা। ওই তিন উপজেলার শতাধিক পরিবার আখের রস থেকে লালি তৈরির কাজ করেন। এর মধ্যে বিজয়নগর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি লালি তৈরি হয়। প্রতিদিন অন্তত এক হাজার কেজি লালি তৈরি হয় সেখানে।
বিজ্ঞাপন
লালি তৈরির জন্য প্রথমে মহিষ দিয়ে আখ মাড়াই করা হয়। এরপর মাড়াইকৃত আখের রস চুলায় দীর্ঘ সময় জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় সুস্বাদু লালি। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে লালি তৈরির কাজ। প্রতি কেজি লালি পাইকারদের কাছে বিক্রি হয় ৭৫ থেকে ৮০ টাকা দরে। আর খুচরা দরে বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১১০ টাকা পর্যন্ত। ক্ষতিকারক উপাদান না থাকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লালি গুণগত মানসম্পন্ন। জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয় এই লালি।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রচুর পরিমাণ জমিতে আখের চাষ হতো। কিন্তু কৃষকরা এখন অন্যান্য ফসল চাষ বেশি করায় আখ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। চলতি মৌসুমে জেলার বিজয়নগর, কসবা ও বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় ৬৮ হেক্টর জমিতে আখের চাষ হয়েছে। আর এসব জমিতে ৪ হাজার মেট্রিক টন আখ উৎপাদন হবে। এসব আখের রস থেকে তৈরি হবে অন্তত ৬শ মেট্রিক টন লালি। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা।
সরেজমিনে বিজয়নগর উপজেলায় গিয়ে দেখা গেছে, কৃষকরা বাড়ির আঙিনায় মহিষ দিয়ে আখ মাড়াইয়ের কাজ করছেন। আখ মাড়াইয়ের জন্য মহিষের চোখে কাপড় বেধে দেয়া হয়। দিনভর আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে রস সংগ্রহের পর রাতে সেই রস চুলায় জ্বাল দেয়া হয়। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় জ্বাল দেয়ার পর তৈরি হয় সুস্বাদু লালি।
বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের লালি তৈরির কারিগর রুক্কু মিয়া জানান, চলতি মৌসুমে তিনি ১৫ হাজার টাকায় এক কাণি জমির আখ কিনেছেন। এই আখ দিয়ে যে পরিমাণ লালি হবে, তা বিক্রি করে সব খরচ বাদ দিয়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাভ হবে তার।
আরব মিয়া নামে আরেক কারিগর বলেন, আগে বাজারে নিয়ে লালি বিক্রি করতে হতো। এখন পাইকাররা আমাদের বাড়িতে এসে লালি কিনে নিয়ে যান। এ বছর লালি বিক্রি করে আমার এক লাখ টাকার মতো লাভ হবে। প্রতি বছর শীতের সময়টাতে লালির ব্যবসা করে ভালো টাকা আয় হয়। এতে করে পরিবারের অভাব-অনটন দূর হয়।
ইদ্রিস মোল্লা নামে গ্রামের এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, কৃষকরা এখন জমিতে অন্য ফসল চাষের কারণে আখ চাষ কমে গেছে। কিছু কৃষি পরিবার পূর্ব-পুরুষদের ব্যবসা ধরে রাখতে লালি তৈরির জন্য আখ চাষ করেন। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কৃষকরা আখ চাষেও আগ্রহী হয়ে উঠবে বলে মনে করেন তিনি।
এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রবিউল হক মজুমদার বলেন, আমরা আশা করছি এবারের মৌসুমে অন্তত ৪ কোটি টাকার লালি বিক্রি হবে। আগে প্রচুর পরিমাণে লালি তৈরি হতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কিন্তু এখন কৃষকরা জমিতে ধানের পাশপাশি বিভিন্ন লাভজনক ফসল চাষ করছেন। এতে করে আখ চাষ কমিয়ে দিয়েছেন তারা। এতে করে লালিও কম তৈরি হচ্ছে। এখনও কিছু কৃষক ঐতিহ্য ধরে রাখতে আখ চাষ করছেন।
এসপি