করোনা রোগী ও তাদের স্বজনদের অবাধ যাতায়াতে উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলছে হাসপাতালের স্টাফসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে। বাধা দিলেও মানছেন না রোগী ও তাদের স্বজনরা। এমন দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। তাদের এই অবাধ যাতায়াত ও অসচেতনতার কারণে সংশ্লিষ্টরা ভয়াবহ অবস্থায় পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সোমবার (৫ জুলাই) জেলার একমাত্র কোভিড-১৯ হাসপাতাল সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট শেখ ফজিলাতুননেসা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিট ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। পাশাপাশি এই ইউনিটে দায়িত্বরত স্টাফরা বলছেন জনবল সংকটের কথা। অন্যদিকে হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় আইসিইউর সংকটে গুরুতর রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না হাসপাতালটিতে। হাসপাতালে চারটি আইসিইউ বেড থাকলেও এর দুটিই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। যে দুটি বেড সচল আছে তাও লিকুইড অক্সিজেন প্ল্যান্ট না থাকায় কাজে আসছে না।

সোমবার সকালে হাসপাতালে ঢুকতেই দেখা গেল বিভিন্ন জায়গায় রোগী ও তাদের স্বজনদের দাঁড়িয়ে বা বসে আছেন। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই মাস্ক নামিয়ে রেখেছেন মুখের নিচে। লিফটে দেখা হয় হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় রাজুসহ আরও দুজনের সঙ্গে। এর মধ্যে একজন করোনা ইউনিটে ভর্তি থাকা রোগী। তিনি মাস্ক পরলেও মুখ খোলা রেখে নামিয়ে রেখেছেন থুতনির নিচে। জানতে চাইলে জানালেন, চা খেতে গিয়েছিলেন। নারী ইউনিটের ভেতরে যেতেই দেখা গেল, রোগীর পাশেই স্বজনরা বসে আছেন মাস্ক না পরেই। শুধু তাই নয়, এরা রোগীর কাছে আসা যাওয়া করছেন ইচ্ছা মতো। মানছেন না কোনো নিয়ম নীতি। বারান্দায়ও দেখা গেল আরও কয়েকজন করোনা রোগীকে। জানতে চাইলে তারা বলেন, সারাদিন শুয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে না।

করোনা ইউনিটে দায়িত্বরত নার্স রহিমা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে ১৬ জন করোনা রোগী ও ৯ জন করোনার উপসর্গ ভর্তি আছেন। এর বিপরীতে চার জন ডাক্তার, চার জন নার্স ও ছয় জন ওয়ার্ডবয় কাজ করছেন। আরও বেশি জনবল দরকার। এছাড়া গুরুতর রোগীদের অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলেও জানান তিনি।

ওয়ার্ডবয় রাজু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা গত ছয় মাস হলো কোনো বেতন পাই না। শুধু ঈদের আগে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল।

সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালে চারটি আইসিইউ বেড থাকলেও দুটি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ব্যবহার উপযোগী দুটি বেডও লিকুইড অক্সিজেন প্ল্যান্ট না থাকায় এবং অন্য রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করায় করোনা রোগীরা পাচ্ছেন না। 

অন্যদিকে কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় করোনা রোগীরা ইচ্ছা মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতে ঝুঁকিতে পড়ছেন অন্যরা। এছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গর্ভবতী রোগীরা পড়েছেন মহা বিপদে। ডেলিভারির সময় হলেও রোগী করোনা আক্রান্ত হওয়ায় এই হাসপাতালে করা হচ্ছে না অপারেশন, বলা হয়েছে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে। এমন অভিযোগ করেছেন তাড়াশ এলাকার রোগী শামিমা খাতুনের স্বামী। এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, এখানে স্ত্রীর অপারেশনের অনুমতিও পাচ্ছেন না তিনি।

নারী ইউনিটে রোগীর একজন স্বজনকে মাস্ক ছাড়াই বসে থাকতে দেখা গেল রোগীর পাশে। কাজীপুর থেকে আসা ওই ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইলে নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তিনি। তবে জানান, তিনি একটি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। মাস্ক না পরে থাকা ঠিক হয়নি বলেও জানান তিনি। তার মতে, হাসপাতালে নির্দিষ্ট নিয়ম থাকলে রোগী ও স্বজনদের এই অবাধ যাতায়াত ও স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হয়ে যেত।

হাসপাতালের পরিসংখ্যানবিদ জেবুন্নাহার বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে ১৬ জন করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি আছেন। এ পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ১৬৭ জন রোগী ভর্তি হয়ে সেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৪৬ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও মারা গেছেন দুজন। এছাড়া অন্য হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে তিন জনকে। তিনি আরও জানান, সিরাজগঞ্জে গত বছরের ২৬ আগস্ট প্রথমে বাগবাটি ৩০ শয্যা হাসপাতালকে করোনা হাসপাতাল হিসেবে চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু হয়। সেখানে ৬৪ জন চিকিৎসা নেওয়ার পর এই হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করা হয়।

সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট শেখ ফজিলাতুননেসা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মো. ফরিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোভিড-১৯ রোগীদের বাইরে বের হতে নিষেধ করলে তারা স্টাফদের সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণ করেন। এছাড়া স্বজনসহ সবার যাতায়াতে একটা নিয়ম করে দেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছে। 

তিনি আরও বলেন, এখানে একটা লিকুইড অক্সিজেন প্ল্যান্ট নির্মাণের কাজ চলছে। এটা সম্পন্ন হলে অক্সিজেনের সরবরাহ বেড়ে যাবে ও সমস্যা কেটে যাবে। জনবল সংকটের বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে বলেন, এসব সমস্যা কেটে যাবে। 

যেহেতু করোনাক্রান্তদের জন্য আইসিইউর ব্যবস্থা নেই। তাই করোনা হাসপাতাল হিসেবে এটা কতটা কাজ করতে পারছে ও সামনে আরও খারাপ অবস্থা হলে কী হবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, অক্সিজেন প্ল্যান্ট চালু না হওয়া পর্যন্ত গুরুতর রোগীদের এই হাসপাতালে খুব বেশি চিকিৎসাসেবা পাওয়ার সুযোগ নেই।

জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা করোনা রোগী ও স্বজনদের অবাধ যাতায়াত বন্ধ করব। করোনা মোকাবিলায় এখন ৫০ শয্যা ব্যবহার করা হচ্ছে। সামনে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হলে সেটা আমরা আরও বাড়াব। এছাড়া লিকুইড অক্সিজেন প্ল্যান্টের কাজ শেষ হলে আইসিইউগুলো চালু করব।

সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে সিরাজগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. রাম পদ রায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

তবে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. সৌমিত্র বসাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এসবে বিষয় নিয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে সাবধান করব। লিকুইড অক্সিজেন প্ল্যান্ট চালু না হলে করোনা রোগীদের আইসিইউ সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না বলেও জানান তিনি।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পরিসংখ্যানবিদ হুমায়ন কবীর ঢাকা পোস্টকে জানান, জেলায় সোমবার পর্যন্ত মোট ৩৪ হাজার ৪৭৭ জনের নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এর বিপরীতে পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন চার হাজার ৮৮৯ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন তিন হাজার ৫৮৯ জন। জেলায় এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৩২ জনের।

শুভ কুমার ঘোষ/এসএসএইচ