৩০ জুন, সন্ধ্যা পৌনে ৬টা। হঠাৎই বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। করোনা ইউনিটে অক্সিজেনের চাপ কমে যাওয়ায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটতে থাকে একের পর এক রোগীর মৃত্যু। ৫-১০ মিনিটের মধ্যে মারা যান হাসপাতালের আইসিইউতে থাকা ৩ জন। এর একটু পর মারা যান আরও একজন।

এরই মধ্যে পুরো হাসপাতালে ছড়িয়ে পড়ে অক্সিজেন সংকটের খবর। বন্ধ করে দেওয়া হয় আইসিইউর মূল গেট। এতে রোগীর স্বজনরা দিশেহারা হয়ে পড়েন।

ঘটনার সময় হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন মৃত নাজমা খাতুনের মেয়ের স্বামী শাহজাহান আলী। তিনি ঢাকা পোস্টকে সেই শ্বাসরুদ্ধকর সময়ের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘মেডিকেলে রোগীদের সেন্ট্রাল অক্সিজেন থেকে হাইফ্লো ন্যাজাল অক্সিজেন দেওয়া হয়। সেন্ট্রাল অক্সিজেনের চাপ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক ডা. মানস কুমার মন্ডল আইসিইউর গেট বন্ধ করে দেন। মুহূর্তের মধ্যেই গোটা হাসপাতালে ‘অক্সিজেন সংকট দেখা দিয়েছে’- এমন কথা ছড়িয়ে পড়ে। হৈ-চৈ পড়ে যায় রোগী ও স্বজনদের মধ্যে।’ 

তিনি বলেন, ’সেই রাতে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল, আমরা হাসপাতাল থেকে শাশুড়ির মরদেহ নিয়ে বের হয়েছি রাত ১০টার দিকে। আইসিইউতে আরও দুইজন মারা যায়। পরে শুনেছি আরও কয়েকজন মারা গেছে।’

অক্সিজেন সংকটে সেদিন একইভাবে মারা যান সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার ভাড়াশিমলা গ্রামের আকরাম হোসেন খান (৬৩)। তিনিও আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

ঘটনার সময় হাসপাতালে উপস্থিত থাকা আকরাম হোসেন খানের ছেলে তাজ মোহাম্মদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিকেলে আসরের নামাজের আগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত অক্সিজেনের একটু সমস্যা হবে, চাপ কম থাকবে। তবে তার আগেই (৬টার দিকে) অক্সিজেনের সংকট দেখা দেয় এবং চাপ কমে যায়। আইসিইউতে হাইফ্লো ভেন্টিলেটর ও দেয়ালে লাগানো লাইনের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সে সময় কোনো মেশিনে অক্সিজেন সাপ্লাই ছিল না। সরবরাহ লেভেল ১০ এর নিচে নেমে যায়। মুহূর্তের মধ্যে ছফফট করতে করতে আইসিইউ ও সিসিইউতে ছয়জন মারা যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার আগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কেউ সরাসরি বলেনি যে অক্সিজেন সংকট থাকবে। কিন্তু তাদের কথাবার্তায় পরে বুঝেছি, অক্সিজেন থাকবে না এটা বোঝাতে চেয়েছিল। যশোর থেকে রাত ৮টার পরে গাড়ি এসে যখন সেন্ট্রাল লাইনে অক্সিজেন দেয় তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। সেন্ট্রাল লাইনে অক্সিজেন না থাকায় এমনটি ঘটেছে। তবে কথা হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ জানত অক্সিজেন ফুরিয়ে আসছে, তাহলে তারা আগেভাগেই কেন ব্যবস্থা নেননি? এই প্রশ্ন আমার এবং আমাদের সবার।’ 

’ডাক্তারদের চেষ্টার কমতি ছিল, দায়িত্বে অবহেলা ছিল। তারা দায়িত্ববান হলে আমি আজ বাবাহারা হতাম না। তারা যদি চেষ্টা করত তবে মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম’— বলছিলেন তাজ মোহাম্মদ।

এদিকে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের রেজিস্ট্রারে ৩০ জুন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যুর নাম ঠিকানা লিপিবদ্ধ রয়েছে। হাসপাতালে থাকা রোগীর স্বজনদের ভাষ্যমতে সন্ধ্যা পৌনে ৬টা থেকে অক্সিজেন সংকট দেখা দেয়। সংকট চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। অর্থাৎ দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা ছিল অক্সিজেন সংকট।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সেই রেজিস্ট্রারে দেখা যায়, আইসিইউতে চিকিৎসাধীন কালিগঞ্জ উপজেলার মৌতলা ইউনিয়নের ভাড়াশিমলা গ্রামের আকরাম হোসেন খান মারা যান ৭.৩০ মিনিটে। দেবহটা উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের তুহিন মারা যান ৭.৫০ মিনিটে। শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের আশরাফ হোসেন মারা যান ৭.৫৫ মিনিটে। ৬.৩৫ মিনিটে মারা যান শহরের কুকরালী এলাকার মনিরুজ্জামানের স্ত্রী নাজমা বেগম। সিসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহরের ইটাগাছা এলাকার খায়রুননেছা ও কলারোয়া উপজেলার সুফুরা বেগম মারা যান ৭.৩০ মিনিটে। অক্সিজেন সংকটের সময় ছাড়াও দিনের বিভিন্ন সময়ে মারা গেছেন আরও ৮ জন।

এদিকে, অক্সিজেন সংকটে রোগী মৃত্যুর ঘটনায় ১ জুলাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতর পৃথক দুটি তদন্ত টিম গঠন করে। হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়কের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত টিমের প্রধান করা হয় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. কাজী আরিফ আহম্মেদকে। এছাড়া ডা. সাইফুল্লাহ্ ও ডা. মারুফ আহম্মেদকে সদস্য করা হয়। তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে তদন্ত টিম প্রধান ডা. কাজী আরিফ আহম্মেদ তদন্ত কার্যক্রম শেষ করতে না পারায় রোববার (৪ জুলাই) আরও সাতদিন সময়ের আবেদন করলে তত্ত্বাবধায়ক সময় বাড়ান।

অন্যদিকে, একই ঘটনায় খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. রাশিদা সুলতানা পৃথক আরেকটি তদন্ত টিম গঠন করেন। টিমের প্রধান করা হয় খুলনা বিভাগের সহকারী স্বাস্থ্য পরিচালক রফিকুল ইসলাম গাজীকে। এই টিমের সহকারী সদস্য মোংলা পোর্টের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শেখ মোশারফ হোসেন। এই কমিটি রোববার (৪ জুলাই) সরেজমিন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন ও ২২ কর্মকর্তা-কর্মচারীর লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করেন। তবে তদন্তের দিন গণমাধ্যমে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেননি সহকারী স্বাস্থ্য পরিচালক রফিকুল ইসলাম গাজী।

তদন্ত টিমের প্রধান খুলনা বিভাগের সহকারী স্বাস্থ্য পরিচালক রফিকুল ইসলাম গাজী জানিয়েছিলেন, সাতক্ষীরা মেডিকেলে অক্সিজেন সংকটে রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়েছে। বিধিমোতাবেক সার্বিক ঘটনার প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দফতরে দাখিল করা হবে। এই মুহূর্তে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়।

ঘটনার বিষয়ে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের তত্ত্বাবধায়ক ডা. কুদরত-ই-খোদা বলেন, ‘হাসপাতালে অক্সিজেনের কোনো সংকট ছিল না। তবে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সেন্ট্রাল লাইনে অক্সিজেনের চাপ কমে যায়। এ কারণে অতি মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকা ছয় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। বাকিদের কোনো অসুবিধা হয়নি। অক্সিজেনের অভাবে রোগীদের মৃত্যু হয়েছে এটি সম্পূর্ণরূপে ‘অপপ্রচার’। এ ঘটনায় তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিস্তারিত জানা যাবে।’

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গঠিত তদন্ত টিমের প্রধান ডা. কাজী আরিফ আহম্মেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, তদন্ত কার্যক্রম ইতোমধ্যে শেষ করেছি। আগামী শনিবার (১০ জুলাই) প্রতিবেদন দাখিল করব। তখন গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানানো হবে। এ মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না।

তবে এ ঘটনার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওই তদন্ত প্রতিবেদনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে কোনো অবহেলা পাননি তদন্ত কমিটি। তবে অক্সিজেন যথাসময়ে সরবরাহ না থাকায় অক্সিজেন চাপ কমে গিয়ে এ ঘটনা ঘটেছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারত থেকে এই অক্সিজেন আমদানি করে সরবরাহ করা হয়।

দেশে করোনার সবশেষ পরিস্থিতি

দেশে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ঠেকাতে সারা দেশে সর্বাত্মক বিধিনিষেধ ১৪ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। গত ২ দিনে (৭ ও ৮ জুলাই) করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া এ দুদিনে করোনা শনাক্ত হয়েছে ২০ হাজারের বেশি মানুষের।

এসএম/জেএস