অসুস্থ স্বামী আর সন্তানদের সঙ্গে ভূমিহীন ছকিনা বেগম

‘টাকার অভাবোত স্বামীর চিকিৎসা হওচে না। ছাওয়া তিনটাক নিয়্যা যত চিন্তা। কী করিম, কার কাছে যাইম। কিছুই জানো না। এই টাকার অভাবোত বিনা চিকিৎসাত মোর শ্বশুর-ভাসুর মরি গেইছে। এ্যালা (এখন) স্বামীও মরার পথে। কাইল কি খামো তার চিন্তা। স্বামীর চিকিৎসার চিন্তা। সোগ (সবকিছু) মিলি হামার খুব কষ্টত দিন যাওছো। কায়ো হামার খোঁজ নেয় না।’ এভাবেই অশ্রুসিক্ত নয়নে কথাগুলো বলছিলেন ছকিনা বেগম।

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের পূর্বদেবু আনন্দ বাজার গ্রামে থাকেন ছকিনা বেগম। এটি তার স্থায়ী ঠিকানা নয়। কারণ, নিজের জমিজমা বা ভিটেমাটি নেই। নেই মাথা গোঁজার মতো একটা ভালো বসতঘরও। নুন আনতে পান্তা ফোরানোর অবস্থা ছকিনার সংসারে।

ভিটেমাটিহীন ছকিনা বেগম সুখের আশায় ১৮ বছর আগে বিয়ে করেছিলেন ভূমিহীন রফিকুল ইসলামকে। দুজনের পরিবারও ভূমিহীন। নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি। অন্যের জমিতে এক টুকরো জায়গাতে তোলা কুঁড়েঘরটিই তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে ছকিনা বেগম বলেন, ‘মাইনষের (অন্যের) জমিত থাকি। ছোট একনা ঘর। তাও ফির কোনো রকম। টাটিবেড়া (বাঁশের তৈরি একধরনের বেড়া) কিছুই ঠিক নাই। ভাঙ্গা দিয়্যা আইত হইলে এই শীতোত বাতাস সোন্দায় (ঢোকে)। সাতাও (ঝড়-বৃষ্টি) হইলে ঘরোত পানি পড়ে। স্বামী-ছাওয়া আর শাশুড়িক নিয়্যা এই ঘরোত থাকি। স্বামীর ব্যারাম (অসুস্থ)। এই অবস্থাত কিছু করার উপায় নাই। কষ্টোতে হামার দিন কাটে।’

দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে ছকিনার সংসার। বড় দুই মেয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। অভাবের তাড়না আর খরচ জোগাতে না পারায় এখন তাদের পড়ালেখা বন্ধ। বর্তমানে অসুস্থ স্বামী, তিন সন্তান আর বৃদ্ধ শাশুড়িকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে চালিয়ে যাচ্ছেন ছকিনা বেগম।

অসুস্থ রফিকুল ধারদেনা করে অনেক টাকা খরচ করেছেন। তিনি জানান, এখন আর কেউ দেয় না। প্রায়ই অসুস্থ হন। এভাবে কত দিন চিকিৎসা করতে হবে, তাও তার জানা নেই। তার বাবা আর ভাইয়েরও রোগ হয়েছিল। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি। একই অবস্থা এখন তারও।

অভাবের সংসারে একমাত্র কর্মক্ষম ছিলেন রফিকুল ইসলাম। আয়-রোজগারের সে মানুষটি গত ছয় মাস থেকে অসুস্থ। এর মধ্যে তার শ্বশুর মারা গেছেন বলে জানান ছকিনা বেগম। ঢাকা পোস্টকে চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী এই নারী বলেন, ‘মোর স্বামীর মেরুদণ্ডের হাড় ক্ষয় হইছে। তায় এ্যালা (এখন) ঠিকমতো চলাফেরা করবার পারে না। লাঠিত ভর দিয়্যা হাটা চলা করে। এত কষ্ট, তার ভিতর কয়দিন (২৯ ডিসেম্বর) আগোত শ্বশুর মরি গেইছে।’

রফিকুলের ব্যাপারে আমি খোঁজ রাখি। তবে তাকে যদি ওই এলাকার কেউ তাদের জমি দান করেন, পরবর্তী তালিকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তার থাকার জন্য ঘর করে দেওয়া ব্যবস্থা করা যাবে।

রওশন জমির রবু সরদার, চেয়ারম্যান, তাম্বুলপুর ইউনিয়ন পরিষদ

রফিকুল ইসলামের বাবা বৃদ্ধ কছিম উদ্দিন অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। তাকে দাফন করা হয় স্থানীয় মসজিদের কবরস্থানে। মসজিদের করবস্থানে দাফন করার জন্য মসজিদ কমিটিকে গরু বিক্রি করে পাঁচ হাজার দিতে হয়েছে বলে জানান ছকিনা বেগম।

এ ব্যাপারে স্থানীয় মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহ জাহান মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, মসজিদের জায়গায় কবর দেওয়ার নিয়ম অনুযায়ী দাফনের জন্য টাকা নেওয়া হয়েছে। এটা মসজিদ কমিটি ও সমাজের সিদ্ধান্তে হয়েছে। পরে আবার আমরা সবাই মিলে গ্রামে চাঁদা তুলে রফিকুলের বাবার কুলখানি করে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে ওই গ্রামের আব্দুর রশিদ, আব্দুল মান্নান ও জাফর ইকবাল জানান, রফিকুল-ছকিনার অভাবের সংসারে হাল ধরার কেউ নেই। সুখ তাদের কপালে জোটেনি। অভাব-অনটনে দিন কাটলেও এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পায়নি। কত ভূমিহীন মানুষের পুনর্বাসন হচ্ছে। কিন্তু এদের বেলায় কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। এ জন্য বছরের পর বছর ধরে অন্যের জমিতে জীবন কাটছে।

রফিকুলের চিকিৎসা ও থাকার জন্য একটি ঘর দরকার বলে জানান তাম্বুলপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুল কুদ্দুছ ভূইয়া। তিনি বলেন, আমি সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করি সহযোগিতা করার। মাঝেমধ্যে ওষুধ কেনার জন্য রফিকুলকে টাকা দিই। আমার মতে, এই অসহায় পরিবারের সাহায্যে সবার এগিয়ে আসা উচিত।

এ ব্যাপারে তাম্বুলপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রওশন জমির রবু সরদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, রফিকুলের ব্যাপারে আমি খোঁজ রাখি। তবে তাকে যদি ওই এলাকার কেউ তাদের জমি দান করেন, পরবর্তী তালিকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তার থাকার জন্য ঘর করে দেওয়া ব্যবস্থা করা যাবে।

এনএ