স্বজনদের কবরের অবস্থা দেখে কাঁদলেন শামীম ওসমান
‘আমি একজন ব্যর্থ সন্তান। আমি আমার বাবা-মা, ভাই, স্বজনদের কবরগুলোও রক্ষা করতে পারিনি। আমি ব্যর্থ বলেই শ্মশানের মরদেহ পোড়া মাটি দিয়ে আমার বাবা-মায়ের কবর ভরা হয়েছে।’
সোমবার (০৯ আগস্ট) দুপুরে শহরের মাসদাইর এলাকায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন কেন্দ্রীয় কবরস্থানে কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। তিনি স্বজনদের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে দোয়া করেন এবং দুই হাত তুলে ক্ষমা চান।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগ উঠেছে, কেন্দ্রীয় শ্মশানের মরদেহ পোড়ানো ছাই ফেলা পুকুরের মাটি দিয়ে ভরাট হয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী ওসমান পরিবারের মৃত সদস্যদের কবরসহ আশপাশে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবর।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ওসমান পরিবারের কবর ছাড়াও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থ করার জন্য সংরক্ষিত অংশের কবরগুলোর ওপর শ্মশানের পুকুর কেটে তোলা মাটি ফেলে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধার কবরের সাইনবোর্ড, বেষ্টনী পর্যন্ত তুলে ফেলা হয়েছে। শ্মশানের মাটি কবরস্থানে রেখে রীতিমত টিলা বানিয়ে রাখা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
শ্মশানের পুকুর কেটে কবরের ওপর মাটি ফেলায় শামীম ওসমানের দাদা খান সাহেব এম ওসমান আলী, দাদি জামিলা ওসমান, বাবা ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবুল খায়ের মোহাম্মদ (একেএম) সামসুজ্জোহা, মা ভাষা সৈনিক নাগিনা জোহা ও বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা একেএম নাসিম ওসমানসহ ওসমানের কবর প্রায় নিশ্চিহ্নের কাছাকাছি। পাশেই একাধিক মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেকগুলো সাধারণ কবরের অস্তিত্বই হারিয়ে গেছে
বিষয়টি নিয়ে চরমভাবে মর্মাহত শামীম ওসমান বলেন, গত ২৭ জুলাই সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর প্রয়াত মা মমতাজ বগমের কবর জিয়ারত করে কবরস্থানে স্বাভাবিক অবস্থা দেখে গেছি। অথচ এরই মধ্যে সিটি কপোরেশনের নিয়োগকৃত ঠিকাদার মামুন মিয়া কবরস্থানের পাশে শ্মশানের পুকুর খননসহ সংস্কার কাজ করতে গিয়ে তার পরিবারের চার সদস্য ও বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধারসহ অন্তত অর্ধশতাধিক কবর ভরাট করে ফেলেছে। কবরস্থানের পশ্চিম দিকে বেশ কিছু জায়গায় ওই মাটি ফেলে ভরাট করায় কবরগুলো কয়েক ফুট নিচে দেবে গেছে। শ্মশানের মাটি কবরগুলোর ওপরে ফেলায় বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার কবরের সাইনবোর্ডও ভেঙে গেছে।
তিনি আরও বলেন, এই অমানুষিক কাজটি যারা করেছে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননাসহ ধর্মীয় অনুভূতিতে চরম আঘাত করেছে। এ ঘটনার মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা হয়েছে।
শামীম ওসমান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, সন্তান হিসবে আমি ব্যর্থ যে আমি স্থানীয় সংসদ সদস্য হয়েও বাবা-মায়ের কবরের পবিত্রতা হেফাজত করতে পারিনি। সেই সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবরগুলোকে অবমাননার হাত থেকে রক্ষা করতে পারিনি। আপনাদের মা-বাবার কবরে শ্মশানের মরদেহ পোড়া মাটি কেউ ঢেকে দিলে আপনারা কি সহ্য করবেন? একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে তিনি এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে কবরগুলো পূর্বের অবস্থায় ফিরিতে আনতে সেখানে দায়িত্বরতদের ৪৮ ঘণ্টা সময় দেন।
এদিকে শ্মশানের পুকুর সংস্কার কাজের ঠিকাদার মামুন মিয়া ও কবরস্থান মসজিদের পেশ ইমাম বদর শাহ ও মুয়াজ্জিন মো. জাকারিয়ার কাছ থেকে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে।
শ্মশানের পুকুর সংস্কার কাজের ঠিকাদার মামুন মিয়া জানান, তিনি পুকুরের মাটি কেটে তোলার পর কবরস্থান মসজিদের ইমাম বদর শাহ ও মসজিদ কমিটির সদস্য মো. শামসু আমার কাছ থেকে কবরস্থানের জন্য মাটি চান। আমি তাদের কথা মতো মাটিগুলো কবরস্থানের মেইন গেটের বাইরে রাখি। পরে কবরস্থান মসজিদের ইমাম ও কমিটির লোকজন শ্রমিক দিয়ে মাটিগুলো কবরস্থানের ভেতরে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কবরস্থান মসজিদের ইমাম বদর শাহ বলেন, কবরস্থানে শ্মশানের মাটি দেওয়া সমীচীন নয়। এখানে শুধু ধর্মীয় বিষয়ই না, এটা মানবিক দিক থেকেই উচিত নয়। নাপাক মাটি কবরে দেওয়া উচিত নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তবে ঠিকাদার মামুন মিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী কবরস্থানের জন্য আপনিই মাটি চেয়েছেন জানিয়ে বক্তব্য চাইলে ইমাম বদর শাহ এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
অপরদিকে মসজিদের মোয়াজ্জিন ও কবরস্থানের দেখভালের দায়িত্বে থাকা মো. জাকারিয়া বলেন, এটা শ্মশানের মাটি। ঠিকাদাররা শ্মশান ও কবরস্থানের উন্নয়ন কাজ করছে। যেহেতু কবরস্থান ও শ্মশানের দেখাভাল করে সিটি করপোরেশন তাই আমরা বাধা দেইনি। তবে শ্মশানের মরদেহ পোড়া মাটি কবরের ওপর দেওয়া উচিত হয়নি।
রাজু আহমেদ/আরএআর