হঠাৎ করে তিস্তার পানি বেড়ে তীব্র ভাঙনের মুখে পড়েছে এপার-ওপার। ভাঙনে দিশেহারা নদীতীরবর্তী পরিবারগুলো। মিলছে না মাথা গোঁজার ঠাঁই। তিস্তার করালগ্রাসে বিধ্বস্ত হয়েছে লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার ঘরবাড়িসহ ভিটামাটিও। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ফসলি জমি, খেলার মাঠ। ভাঙনের মুখে রয়েছে অসংখ্য স্থাপনা।

তিস্তার পানিপ্রবাহ বেড়ে তিস্তার বুকে অসংখ্য চর জেগে ওঠায় নদী প্রায় দুভাবে বিভক্ত হয়েছে। আর এভাবেই প্রতিবছর দুই তীর গিলে খাচ্ছে তিস্তা।

বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টায় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৮২ সেন্টিমিটার (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার)।

সরেজমিনে লালমনিরহাটের ৫ উপজেলায় দেখা গেছে, একসময়ের সুবজ আর সাদা রঙের গ্রামের বালুতে তাজা ফসল হতো। কিন্তু পানি বেড়ে যাওয়ায় তলিয়ে গেছে সবকিছু। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ফসলি জমি, খেলার মাঠ। ভাঙনের মুখে রয়েছে অসংখ্য স্থাপনা। অনেকেই উপায় না পেয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিচ্ছেন।

৫০ বছর আগে মাত্র সাতটি পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছিল তিস্তা নদীর বুকে হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না ইউনিয়নে চিলমারীপাড়া গ্রাম। আজ বসতভিটা ও আবাদি জমি হারিয়ে এই গ্রামের সহস্রাধিক মানুষ এখন আশ্রয় নিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে।

এ ছাড়া তিন দিকে ভারত, এক দিকে তিস্তা নদীবেষ্টিত ২২ কিলোমিটারের দেশের আলোচিত ভূখণ্ড দহগ্রাম ইউনিয়ন। তিস্তার ভাঙনে দহগ্রামের আয়তন ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। ভাঙন ঠেকাতে চার কিলোমিটার এলাকায় ব্লক তৈরি ও বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। সেই কাজ এখনো শেষ হয়নি। এদিকে তিস্তা ক্রমেই ভেঙেই চলেছে। জমিজমা, বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। সেখানকার পানিবন্দি মানুষদের অভিযোগ, প্রতিবছর পানি বাড়লেই এখানে এসে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা ব্লক ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করে। এতে কিছুই হয় না তিস্তাপারের মানুষদের। এক রকম তারা প্রতিবছর তিস্তার মানুষদের নিয়ে ব্যবসা করেন বলে তারা অভিযোগ করেন।

তিস্তা নদীর বাম তীরের ভাঙন ও বন্যা থেকে রক্ষায় ২০০৩-০৪ সালে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে আদিতমারী উপজেলার গোবর্দন এলাকায় সলেডি স্প্যার বাঁধ ২ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। গত বছর কিছু অংশে ভাঙন দেখা দিলে তা সংস্কার শুরু করে। সেই সংস্কারকাজ শেষ হতে না হতেই গত ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে তিস্তায় পানি কমে যাওয়ায় হঠাৎ ভাঙনে কবলে পড়ে বাঁধটি। কিন্তু পানি কমে গেলেও এবার সেটির কোনো কাজ করেনি পাউবো। বৃহস্পতিবার পানি বেড়ে সেটিও এখন ঝুকির মুখে পড়েছেন। গোবর্দ্ধন এলাকায় সলেডি স্প্যার বাঁধ ২ ভেঙে গেলে আদিতমারী উপজেলার হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়বেন।

ভাঙনকবলিত কৃষক সোবাহান মিয়া বলেন, প্রতিবছর এই চিত্র দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে গেলাম। কবে যে আমাদের সুখের দিন আসবে, বুঝতে পারছি না। অনেকে আশ্রয় নিচ্ছেন আত্মীয়স্বজনের জমিতে, অনেকে সরকারি রাস্তার ওপর। দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে চরাঞ্চলের মানুষের জীবন।

চরাঞ্চলের ছফু মিয়া বলেন, তিস্তাপারের মানুষরা পানিবন্দি হয়ে পড়ে। কিন্তু সরকার তিস্তা পাড়ে বাঁধ নির্মাণ করার কোনো চিন্তা করে না। ফের আবারও বন্যা, এই বন্যায় তিস্তা ও ধরলা পাড়ের মানুষদের যে কী হবে, বলা মুশকিল হয়ে পড়েছে। বন্যা যদি বেড়ে যায় এবার, তিস্তা পাড়ের মানুষের দেখার কেউ থাকবে না।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, পানি বেড়ে যাওয়া আগে থেকে বিভিন্ন স্থানে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর কাজ চলছে। এ ছাড়া ভাঙনকবলিত স্থানগুলো পরিদর্শন করা হবে। বরাদ্দ পেলে ভাঙন ঠেকানোর কাজ করা হবে।

বন্যা এলেই তিস্তা পাড়ে কাজ করা বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিস্তাপারের মানুষের এই অভিযোগটি সত্যি নয়। কেননা, সারা বছর তিস্তাপারে পাউবোর লোক পরিদর্শন করে কাজ করেন। যেন তাদের কোনো কষ্ট না হয়।

তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, তিস্তা ব্যারাজের সব গেট খুলে দিয়ে পানির চাপ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ফলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তবে রাতে বিপৎসীমার নিচে নেমে আসারও আশঙ্কা রয়েছে।

নিয়াজ আহমেদ সিপন/এনএ