নলছিটি উপজেলার ষাটপাঁকিয়ার পার্শ্ববর্তী খালে স্লুইসগেটে সাঁকো

বাংলাদেশের দক্ষিণের একটি জেলা ঝালকাঠি। নদীমাতৃক এ জেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী ৮৮ কিমি নদীসীমা ও ১৫৮ কিমি খালসীমা রয়েছে। পাশাপাশি অসংখ্য ছোট খাল ও বেড়ের পানি কৃষিকাজে এ অঞ্চলের মানুষ ব্যবহার করে আসছে যুগ যুগ ধরে।

পানির এ উৎস থেকে কৃষিকাজে ব্যাপক সহায়তার জন্য দক্ষিণাঞ্চলে আশির দশকে বাংলাদেশ পাউবো Barishal Irrigation Project (BIP) নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, যার অধীনে বরিশাল বিভাগের অন্য জেলাগুলোর মতো ঝালকাঠিতেও অনেক পাম্প হাউস স্লুইস, রেগুলেটর, ফ্লাশ ইনলেট ও ক্লোজার বসানো হয়।

জেলায় ২১৭টি স্লুইস ও ২৮টি পাম্প হাউস রয়েছে। এর মধ্যে ঝালকাঠি সদর উপজেলায় ১৪টি পাম্প হাউসে ১১২টি স্লুইস ও নলছিটি উপজেলায় ১৪টি পাম্প হাউসে ১০৫টি স্লুইস। যেগুলো বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিআইপি পোল্ডারের অধীনে।

সরেজমিন দেখা যায়, স্লুইসগেটগুলো এখন আর কোনো কাজে লাগছে না। অসাড় অবস্থায় খাল দখল করে অকেজো দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর। এতে বাধা পাচ্ছে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ। এগুলোর কারণে পানির স্বাভাবিক স্রোতে কমে গিয়ে পলি জমে খাল অনেক জায়গায় সরু হয়ে আসছে। কেউ কেউ আবার স্লুইসগেটগুলোর ওপর কাঠ দিয়ে সাঁকো হিসেবে ঝুঁকি নিয়ে ব্যবহার করছে।

ঝালকাঠি জেলা পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ ঢাকা পোস্টকে জানান, জেলায় ২১৭টি স্লুইস ও ২৮টি পাম্প হাউস রয়েছে। এর মধ্যে ঝালকাঠি সদর উপজেলায় ১৪টি পাম্প হাউসে ১১২টি স্লুইস ও নলছিটি উপজেলায় ১৪টি পাম্প হাউসে ১০৫টি স্লুইস। যেগুলো বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিআইপি পোল্ডারের অধীনে। কাটাখালী পোল্ডার বা উপপ্রকল্পে আছে ৩টি রেগুলেটর। যেগুলো নলছিটি উপজেলার সুবিদপুর ইউনিয়নে স্থাপিত হয়েছে। এ ছাড়া ঝালকাঠির রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলা এবং পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলায় পোল্ডার-৫ বা বিষখালী প্রকল্পে ৮টি রেগুলেটর, ২টি ফ্লাশ ইনলেট এবং একটি ক্লোজার আছে। তার দেওয়া তথ্যে রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলায় কোনো স্লুইসগেটের কথা উল্লেখ না থাকলেও সরজমিনে রাজাপুর উপজেলায় একাধিক স্লুইসগেট অকার্যকর অবস্থায় দেখা যায়।

ঝালকাঠির কিফাইতনগরের খালে স্লুইসে লোহা-স্টিল না থাকলেও আছে আগের অবয়ব

নলছিটি উপজেলার শিক্ষিত তরুণ শরীফ ওসমান জানান, বিভিন্ন ছোট ছোট খালে জন্মের পর থেকেই কিছু স্লুইসগেট দেখছি। কিন্তু এগুলো কী কাজে লাগছে, তা দেখতে পাই না।

কৃষক আবুল খায়ের মৃধা বলেন, হুদাই হালাইয়া থুইছে শুইজ গেটটি। এয়া কি মোগো কোনো কামে লাগে? আরও খালগুলার পানি আইটকা পড়ে, ধান খ্যাতে পানি দেতে এয়া কোনো কামে লাগে না।

একই কথা জানিয়েছেন ঝালকাঠি সদরের বিনয়কাঠি ইউনিয়ন, নথুল্লাবাদ ইউনিয়ন এবং পৌরসভার কিফাইতনগরের একাধিক কৃষক।

স্লুইসগেটগুলো সব অকার্যকর উল্লেখ করে এগুলো অপসারণ করা উচিত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা পানি উন্নয়ন বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. সাজেদুল বারী জানান, অনেক বছর আগে থেকেই বিষয়টি একাধিকবার ওপর মহলকে জানানো হয়েছে। আমরাও মনে করি অপসারণ করা উচিত। কিন্তু সরকার উদ্যোগ না নিলে বা বড় আকারের অর্থ বরাদ্দ না হলে ঝালকাঠিসহ বরিশাল অঞ্চলের ছোট খালগুলোর স্লুইসগেটগুলো অপসারণ করা সম্ভব না।

সাজেদুল বারী জানান, প্রকল্পটি সেচের জন্য করা হলেও এটি শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। পাম্পিং করে পানি সংরক্ষণের কথা ছিল যখন পানির সংকট থাকবে, আবার সেচকাজ হয়ে গেলে গেট খুলে পানি ছেড়ে দেওয়ার কথা। এখন হিতে বিপরীত হয়ে অনেক সময় পানি স্লুইসগেট উপচে প্রবাহিত হয়।

রাজাপুর উপজেলার উত্তর নারিকেলবাড়িয়ার স্লুইসগেট 

একই প্রশ্ন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিলের কাছে করা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, চরাঞ্চলের স্লুইসগেট আর ঝালকাঠির মতো উপকূলীয় জেলার স্লুইসগেট অঞ্চলভেদে একই রকমের হওয়ার কথা না থাকলেও সব এক; যেটা অপ্রত্যাশিত। চরাঞ্চলে পলি আসে কেবল উজান থেকে আর ঝালকাঠিতে পলি আসে দুদিক থেকে। উজান থেকেও, সাগর থেকেও। পানির প্রবাহ রক্ষণাবেক্ষণই কেবল সমস্যা না; ল্যান্ড ফরমেশন প্রসেসও বাধাগ্রস্ত হয়। তাই ছোট খালগুলোর স্লুইসগেটগুলো ধীরে ধীরে অপসারণ করা উচিত।

পবার কেন্দ্রীয় সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, যে পদ্ধতিতে এগুলো বানানো হয়েছিল, সেখানেই একটি ভুল ছিল। এগুলো নষ্ট হওয়ারই কথা আবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় না। এগুলো অপসারণ করে প্রয়োজন হলে নতুনভাবে এমন কিছু করতে হবে, যেন খালের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি না হয়। 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ঝালকাঠি জেলা সভাপতি ও পরিবেশকর্মী ইলিয়াস সিকদার ফরহাদ জানান, এ অঞ্চলের খালগুলোর বোঝা এখন স্লুইসগেটগুলো। খালের স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখতে অপ্রয়োজনীয় স্লুইসগেটগুলোকে দ্রুত অপসারণ করা উচিত।

এনএ