টাঙ্গুয়ার হাওরের একাংশে সামান্য কিছু পাখি উড়ছে

দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ সবচেয়ে বড় জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওরে এবার পরিযায়ী পাখি কম এসেছে। কয়েক বছর আগেও পরিযায়ী পাখির কলকাকলি আর পাখা ঝাপটানোর শব্দে মুখরিত থাকত টাঙ্গুয়ার হাওর। কিন্তু এবার হাওরে শীতের কনকনে হাওয়া বইলেও পরিযায়ী পাখির ভিড় কম। 

হাওরপাড়ের বাসিন্দারা মনে করেন, পাখিদের খাবার সঙ্কট, গাছ কেটে উজাড় করা, হাওরের সকল জায়গায় পর্যটকদের বিচরণ ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচলের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখির সংখ্যা কমছে। হাওরপাড়ের ৮৮টি গ্রামেই কিছু পাখি শিকারী রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে মাছ শিকারীদের উৎপাত। অভিযোগ রয়েছে, পাখি শিকারীরা হাওরের পাহারায় থাকা আনসার-পুলিশদের ম্যানেজ করে এই অপকর্ম করে আসছে।

জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। ছয়কুড়ি বিল, নয়কুড়ি কান্দার সমন্বয়ের এ হাওরের দৈর্ঘ্য ১১ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৭ কিলোমিটার। শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা একেক ঋতুতে এই হাওর একেক রূপ ধারণ করে। 

বর্ষায় অন্যান্য হাওরের সঙ্গে মিশে এটি সাগরের রূপ ধারণ করে। শুকনো মৌসুমে ৫০-৬০টি আলাদা বা সংযুক্ত বিলে পরিণত হয় পুরো হাওর। ১১টি বাগসহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য হিজল-করচ গাছ, নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, হেলেঞ্চা, বনতুলসিসহ শতাধিক প্রজাতির উদ্ভিদ হাওরকে দৃষ্টিনন্দন করে। 

নভেম্বর থেকে এই হাওরে শুরু হয় পরিযায়ী পাখির সমাবেশ। স্থানীয় জাতের পানকৌড়ি, কালেম, দেশি মেটে হাঁস, বালিহাঁস, বকসহ শীত মৌসুমে আসা লক্ষাধিক পরিযায়ী পাখি এখানে যাত্রা বিরতি করে। আবার কোনো কোনো পরিযায়ী পাখি পুরো শীতকাল এখানেই কাটায়। 

সাইবেরিয়া,  মঙ্গোলিয়া, হিমালয়, উত্তর এশিয়া, নেপালসহ পৃথিবীর নানা শীত প্রধান দেশ থেকে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে অতিথি পাখিরা বাংলাদেশের বৃহৎ জলমহাল টাঙ্গুয়ার হাওরে আসে। এসব পাখির মধ্যে লেঞ্জা, পাতিহাঁস, বুটিহাঁস, বৈকাল, নীলশির, পানকৌড়ি, পাতারি, দলপিপি, রাঙ্গামুড়ি,পান্তামুখী প্রভৃতি পাখি মার্চ- এপ্রিল পর্যন্ত অবস্থান করে হাওরে।

এছাড়াও প্রতি বছরই টাঙ্গুয়ার হাওরে সমগ্র দেশের মধ্যে সবচেয়ে বিরল কয়েক জাতের পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে বৈকাল তিলিহাঁস, বেয়ারের ভুঁতিহাস এবং কালোলেজ জৌরালি। 

 হাওরে হাঁসদের ছোটাছুটি

বাংলাদেশে দৃশ্যমান আটটি লেয়ারের ভুঁতিহাসের পাঁচটিই পাওয়া গেছে টাঙ্গুয়ায়। বিরল প্রজাতির পাখিদের মধ্যে আরও রয়েছে- কালোপাখা টেঙ্গি, মোটাঠুঁটি ফাটানো, ইয়ার, মেটে রাজহাঁস, মাছমুরাল, লালবুক গুরগুরি, পাতি লালপা, গেওয়াল বাটান, লম্বা আঙুল চা পাখি, বড় গুটি ঈগল, বড় খোঁপা ডুবুরি, কালো গির্দি প্রভৃতি।

উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের টাঙ্গুয়ার পাড়ের গ্রাম মাটিয়ান। এই গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর মো. ইমরান। ছোটবেলা থেকে এই টাঙ্গুয়ার পাড়েই বড় হয়েছে। তিনি বলেন, কিছু মুনাফাখোর পাখি শিকারির কারণে পাখির সংখ্যা কমতির দিকে। ১৫ বছর আগেও এই হাওরে বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করা হত। এখন প্রশাসনের তৎপরতায় বন্দুক দিয়ে শিকার বন্ধ হয়েছে। তবে শিকারিরা পাখি ধরার জন্য নতুন নতুন কৌশল বের করেছে। এখন সুতা দিয়ে এক ধরনের ফাঁদ তৈরি করে শিকারিরা। এছাড়াও রাতে লাইট দিয়েও পাখি শিকার করা হয়। একই রকমের অভিযোগ আরও অনেকের। 

টাঙ্গুয়াপাড়ের জয়পুর গ্রামের বাসিন্দা মো. আবুল মিয়া বলেন, হাওরপাড়ের বাসিন্দাদের লাকুরি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করলে এই হাওরের বন-বাদালি আগের অবস্থায় আনা যাবে না। ৮৮ গ্রামের গড়ে দেড়শ করে পরিবার হাওর থেকে বন-বাদালি কেটে নিয়ে বিনা খরচায় লাকড়ি ব্যবহার করছে। এই অবস্থার নিয়ন্ত্রণ আনতে বিনামূলে গ্যাসের সিলিন্ডার এবং গ্যাসের চুলা বিতরণের প্রস্তাব করেন তিনি। তার মতে, গাছ-গাছালি রক্ষা হলে জলজ প্রাণীসহ অনেক প্রাণ-বৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।

তাহিরপুর সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা শিক্ষার্থী আদনান হাবিব রাব্বি বলেন, শীতকালে পাখি দেখার জন্য অনেক পর্যটক আসেন আমাদের তাহিরপুরে। তারা  ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে টাঙ্গুয়ায় যান। গভীর হাওরে যেখানে পাখির বাস সেখানে এসব যান নিয়ে ঘুরে দেখেন পর্যটকরা। ফলে পাখি সেখানে থাকে না।

পাখিদের আবাস্থল হিসেবে টাঙ্গুয়াকে গড়ে তুলতে কী করা প্রয়োজন? এমন প্রশ্নের জবাবে এই শিক্ষার্থী বলেন, হাওরের গভীর এলাকাকে পাখিদের অভয়াশ্রম হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। এসব অভয়াশ্রমে জনসাধারণের চলাচলে সম্পূর্ণভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে।

পরিবেশ সংরক্ষণে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার এর (আইইউসিএন) মূখ্য গবেষক সীমান্ত দীপু ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধু সুনামগঞ্জ নয় সারাবিশ্বে পাখির সংখ্যা কমছে। গত ১৫ বছরের মধ্যে ১০-১৫ শতাংশ পাখি কমেছে সারাদেশে। সুনামগঞ্জে পাখি শিকারি ও পর্যটকরা পাখি নিরাপদে থাকার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ান। তবে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর পাখির জন্য নিরাপদ। টাঙ্গুয়াকে পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তুলতে স্থানীয় জনগণসহ প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে।

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদ্মাসন সিংহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে পরিযায়ী পাখিরা আসে খাবার সংগ্রহের জন্য। সবকিছু প্রাকৃতিকভাবে পছন্দ করে পরিযায়ী পাখি। সন্ধ্যার পর সীমান্তে ইন্ডিয়ান লাইট জালানোর জন্য এবার টাঙ্গুয়ায় পাখি কম এসেছে। রামসার প্রকল্পভুক্ত এই হাওর রক্ষণাবেক্ষণে কেউ গাফিলতি করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসপি