মুন্ডা-মাহাতো সম্প্রদায়ের নারীরা শিক্ষায় এগিয়ে
মুন্ডা ও মাহাতো সম্প্রদায়ের মেয়েদের সঙ্গে সৌরভী মুন্ডা
একসময় গ্রামের বাইরের স্কুল-কলেজে যেতে দিতে না। কোনো মেয়ে যদি লেখাপড়া করতে গ্রামের বাইরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ইচ্ছা প্রকাশ করত, তাহলে সেই স্বপ্ন পূরণ হতো না। আর যদি কোনো পরিবার তার মেয়েকে পড়তে যেতে দিত, তাহলে স্থানীয়রা নানা গুঞ্জন শুরু করত।
কেন মেয়েকে বাইরে পড়তে যেতে দিতে হবে, এমন অনেক প্রশ্ন ছিল তাদের। কিন্তু এখন গ্রাম, উপজেলা ছাড়িয়ে খুলনা শহরের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এই গ্রামের ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও। এমনকি খুলনার বাইরেও পড়ছে তারা।
বিজ্ঞাপন
শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছেন এখানকার নারীরা। নিজ ঘরের আঙিনায় দাঁড়িয়ে এমনটাই বলছিলেন কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি শেখ সরদারপাড়া এলাকার সৌরভী মুন্ডা। তিনি খুলনা সরকারি বিএল কলেজের ব্যবস্থাপনায় (অনার্স) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
সৌরভী মুন্ডা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবারের সদস্যরা প্রথম অবস্থায় খুলনা শহরে পড়তে যেতে দিতে চায়নি। আমার অনেক ইচ্ছা ছিল, তবে ভয়ও করত। আমার পাশে দাঁড়ান প্রতিমা মন্ডল নামের এক আপু। তিনি খুলনা সরকারি মহিলা কলেজে লেখাপড়া করেন। তাকে দেখে সাহস হয় শহরে যেতে। এখন অনেকেই খুলনার বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন। আমাদের সম্প্রদায় থেকে অনেক ডিগ্রি পাস করা শিক্ষার্থীও রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সৌরভী মুন্ডা আরও বলেন, মুন্ডা সম্প্রদায়ের অনেক ছেলে-মেয়ে এখন লেখাপড়া করে। তবে ছেলেদের চেয়ে সংখ্যায় মেয়েরাই বেশি। কারণ, ১২ বছর বয়স হলে ছেলে শিশুরা পরিবারের হাল ধরতে কর্মে যোগ দেয়। অনেকে বাবার সঙ্গে ছয় মাস ইটভাটার কাজে চলে যায়। এসে কেউ স্কুলে ভর্তি হয়, আবার কেউ কেউ ঘুরে বেড়ায়।
শুধু সৌরভী মুন্ডাই নন, কয়রা উপজেলার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মুন্ডা সম্প্রদায় এখন শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগামী। শুধু গ্রামের স্কুল-কলেজ নয়, শহরেও লেখাপড়া করছে তাদের সন্তানেরা। শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া এই সম্প্রদায়ের নারীরাই লেখাপড়ার দিকে বেশি ঝুঁকছেন।
এ বিষয়ে কয়রা নৃতাত্ত্বিক আদিবাসী সমবায় সমিতির সভাপতি বলাই কৃষ্ণ সরদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশি ও দক্ষিণ বেদকাশি― এ তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ১২টি গ্রামে মুন্ডা ও মাহাতোর ৩৭০টি পরিবার বসবাস করছে। এসব পরিবারের ২৫৮ জন ছেলে-মেয়ে কয়রা ও খুলনা শহরের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। আগের চেয়ে বর্তমানে মুন্ডা সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়ায় কিছুটা এগিয়েছে। তবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী বেশি। ছেলেদের অনেকে কর্মজীবী হওয়ার কারণে লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়তে হয়।
উপজেলার ৯টি গ্রামে ৩৬০টি মুন্ডা ও মাহাতো পরিবারে ১ হাজার ৭৩০ জন রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব সম্প্রদায়ের জীবিকার পরিবর্তন এসেছে। তাদের জীবন-জীবিকার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের অগ্রগতি হয়েছে। তাদের শিশুদের লেখাপড়ার জন্য স্কুল করা হয়েছে।
অনিমেশ বিশ্বাস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা
বলাই কৃষ্ণ সরদার বলেন, স্থানীয় একটি এনজিও উদ্যোগে কয়রা উপজেলায় ৫টি কমিউনিটি স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে। এই স্কুলগুলোতে শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও শুরু হবে পাঠক্রম।
স্থানীয় ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ব্যক্তিরা জানান, খুলনার দক্ষিণে কয়রা উপজেলায় বহু বছর ধরে মুন্ডা ও মাহাতো সম্প্রদায়ের বসবাস। উপজেলার উত্তর বেদকাশী শেখ সরদারপাড়া, বড়বাড়ি, বতুলবাজার, গাজীপাড়া, হরিহরপুর, দক্ষিণ বেদকাশির আংটিহারা, জোরশিং, বীনাপানি, সদরের মাঝের আইট, টেপাখালী, নলপাড়া গ্রামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন।
দেশে মুন্ডারা কখন কীভাবে বাংলাদেশে এসেছে, তার সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে অনেকের ধারণা, মোগল ও ব্রিটিশ আমলে বনজঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য মুন্ডাদের এ দেশে নিয়ে আসেন স্থানীয় জমিদাররা। বংশপরম্পরায় পরের জমিতে কাজ করা দিনমজুর পরিশ্রমী মানুষগুলো নানা কারণে সমাজের মূলধারার বাইরে।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি আশরাফ উজ জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্ষুদ্র জাতিসম্প্রদায়ের মানুষদের জীবনযাত্রা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। তাদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে জনপ্রতিনিধিদেরও এগিয়ে আসতে হবে। আর শিশুশ্রম বন্ধ করে তাদের শিক্ষার দিকে নজর দিয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনিমেশ বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপজেলার ৯টি গ্রামে ৩৬০টি মুন্ডা ও মাহাতো পরিবারে ১ হাজার ৭৩০ জন রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব সম্প্রদায়ের জীবিকার পরিবর্তন এসেছে। তাদের জীবন-জীবিকার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের অগ্রগতি হয়েছে। তাদের শিশুদের লেখাপড়ার জন্য স্কুল করা হয়েছে। উপজেলার স্কুল-কলেজ ছাড়াও তারা খুলনা সদরের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে।
এনএ