মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাক্ষরে লিখিত অভিযোগ!
মৃত ছয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধার গেজেট নম্বর ব্যবহার করে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি অভিযোগ করার ঘটনা ঘটেছে। ওই ছয় মৃত মুক্তিযোদ্ধার গেজেট নম্বরের পাশে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে জীবিত ৬ মুক্তিযোদ্ধার নাম। জাতির বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এমন ‘তুঘলকি’ কর্মকাণ্ডে হতবাক হয়েছেন অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও।
জানা গেছে, সম্প্রতি সোনারগাঁ উপজেলার বেসামরিক গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির বিরুদ্ধে ওই অভিযোগপত্রটি দাখিল করা হয়েছে জেলা প্রশাসক বরাবর। তবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, শুধু হয়রানি করতেই এমন গর্হিত কাজটি করেছে কোন চক্র।
বিজ্ঞাপন
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, জেলা প্রশাসক বরাবর দাখিল করা অভিযোগে স্বাক্ষর করা আটজন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ছয়জনই মৃত মুক্তিযোদ্ধার গেজেট নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি তাদের স্বাক্ষরও জাল করা হয়েছে। অবাক করা বিষয় হলো, ৪৫ বছর আগে মারা যাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বাক্ষরও রয়েছে সেই অভিযোগপত্রে! ৪ সদস্যবিশিষ্ট বেসামরিক গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগপত্রে ভারতীয় তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে আটজন মুক্তিযোদ্ধার গেজেট নম্বর ও স্বাক্ষর জাল করে লিখিত আবেদন করা হয়েছে। যার মধ্যে ছয়জনই মৃত।
আরও জানা গেছে, ৪৫ বছর আগে মারা যাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা মীরের গেজেট নম্বর ৭২৯। আবুল কাসেম নামে স্বাক্ষর করা একজনের নামের পাশে ব্যবহার করা হয়েছে মৃত মোস্তফা মীরের গেজেট নম্বরটি। এদিকে ওই অভিযোগপত্রের সূত্র ধরে সেই আবুল কাসেমের নম্বরে ফোন কল দেওয়া হলে তিনি অসংলগ্ন তথ্য দেন। তার গেজেট নম্বর জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, তার গেজেট নম্বর ৯২৯। অথচ ডিসি কার্যালয় বরাবর দেওয়া অভিযোগ উল্লেখ রয়েছে আবুল কাসেমের গেজেট নম্বর ৭২৯।
বিজ্ঞাপন
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০ বছর আগে মারা গিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ। তার গেজেট নম্বর ৭২৩। মৃত আবদুল লতিফের গেজেট নম্বরটি ব্যবহার করে স্বাক্ষর করেছেন গোলাম মোস্তফা। সাত বছর আগে মারা যান মো. সামসুল হক। তার বাড়ি সাদীপুর ইউনিয়নের ভারগাঁও কাজীপাড়া গ্রামে। তার গেজেট নম্বর ৫৬২। মৃত সামসুল হকের গেজেট নম্বরটি মো. সৈয়দ হোসেনের স্বাক্ষর করা নামের পাশে ব্যবহার করা হয়েছে। পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান ভূইয়া। তার গেজেট নম্বর ৬৭১। তার বাড়ি জামপুর ইউনিয়নের মিরেরবাগ গ্রামে। মৃত সোলায়মান ভূইয়ার ৬৭১ নম্বর গেজেটের নম্বরটি সোলায়মান মুন্সি নামের একজনের নামের পাশে ব্যবহার করা হয়েছে।
এক মাস আগে মারা গেছেন মতিউর রহমান। তার গেজেট নম্বর ৭২৫। তিনি মারা যাওয়ার পরও অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করেছেন, এমনটাই অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া এক মাস আগে মারা যান আছাদুজ্জামান। তার গেজেট নম্বর ৫৮৬। তিনি মারা যাওয়ার পরও অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে নারায়ণগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা মনে করছেন, সোনারগাঁও উপজেলায় বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইকে সামনে রেখে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য এ ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। ওই অভিযোগপত্রে যাচাই-বাছাই কমিটিতে আলতাফ হোসেন ও অ্যাডভোকেট সফিউদ্দিন ভুঁইয়াকে অন্তর্ভুক্ত করারও দাবি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার মোহাম্মদ আলী বলেন, ৪৫ বছর, ২০ বছর কিংবা ৭ বছর আগে মারা যাওয়া মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে এই লিখিত অভিযোগ করতে পারেন, তা আমার বোধগম্য নয়। মৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম, গেজেট নম্বর ও স্বাক্ষর জাল করে জেলা প্রশাসনে আবেদন করার ঘটনাটি সত্যি। কারণ, নারায়ণগঞ্জের মারা যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নাম আমার মুখস্থ। সম্প্রতি ডিসি অফিসে জমা হওয়া অভিযোগপত্রে মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম দেখে বিষয়টি আমি জেলা প্রশাসকের নজরে আনি। তখনই জেলা প্রশাসক বিষয়টি আমলে নেন। ডিসি সাহেব এবং আমি অবাক হয়েছি, কীভাবে মৃত মুক্তিযোদ্ধারা দস্তখত দিলেন! এটা নিশ্চই জালিয়াতি করে করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনার জন্য দায়ী ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে সোনারগাঁও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার ওসমান গনি বলেন, চিহ্নিত চক্রটি বারবার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের হয়রানি করার জন্য এই ধরনের জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে যাচ্ছে। মৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম, গেজেট নম্বর ও স্বাক্ষর জাল করে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার উদ্দেশ্যে এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে একটি চক্র। তদন্ত কমিটি গঠন করে এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হোক।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানিয়েছেন, সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন জমা দিলেই আমরা বলতে পারব, কারা মারা গেছেন। আবেদনটি বৈধ নাকি অবৈধ। কেউ শত্রুতা করে জমা দিয়েছে নাকি ঠিক আছে।
এনএ