যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড থেকে চেক জালিয়াতি করে ৫ কোটি টাকা আত্মসাতে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান, সচিবসহ অন্যরা বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। স্বপদে থেকে তারা মামলা ও তদন্ত প্রভাবিত করছেন বলে বোর্ডের অনেকে দাবি করেছেন। শুধু তাই নয়, অডিট ও হিসাব শাখাও পুরো বন্ধ করে দিয়েছেন।

শিক্ষা বোর্ডের ২০২০-২১ অর্থবছরের আয়-ব্যয় বোর্ডের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্টের সঙ্গে মিলকরণে দেখা যায়, ব্যয় অ্যাকাউন্ট এসটিডি-২৩২৩২৪০০০০০২৪ হিসাব খাতের ৯টি চেক পরিশোধিত হয়েছে। কিন্তু বোর্ডে সংরক্ষিত মুড়ি বইয়ের চেকে উল্লিখিত টাকার পরিমাণের সঙ্গে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পরিশোধিত টাকার মিল নেই। মুড়ি বইয়ের চেকের তারিখ অনুযায়ী হিসাব শাখায় ব্যয় রেজিস্ট্রারের ব্যয় বিবরণীতে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য চেকগুলো ইস্যু করা হয়। কিন্তু ইস্যুকৃত চেকের বিপরীতে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ সরকারি কোষাগারে অর্থ পরিশোধিত হয়নি। 

শিক্ষা বোর্ডের ইস্যুকৃত ৯টি চেক জালিয়াতি করে দুটি প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে দুই কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা তুলে নিয়েছে। গত ৭ অক্টোবর আত্মসাতের প্রথম ঘটনাটি ধরা পড়ে। 

১৮ অক্টোবর দুদক’র সমন্বিত যশোর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাহফুজ ইকবাল এ বিষয়ে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন, সচিব অধ্যাপক এএম এইচ আলী আর রেজা, হিসাব সহকারী আবদুস সালাম, প্রতারক প্রতিষ্ঠান ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মালিক রাজারহাট এলাকার বাসিন্দা আবদুল মজিদ আলীর ছেলে শরিফুল ইসলাম বাবু ও শেখহাটী জামরুলতলা এলাকার শাহীলাল স্টোরের মালিক মৃত সিদ্দিক আলী বিশ্বাসের ছেলে আশরাফুল আলমের নামে মামলা করেন। 

এরপর ২১ অক্টোবর ধরা পড়ে আরও আড়াই কোটি টাকার জালিয়াতি। সেখানে দেখা যায়, ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট বিজনেস আইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে আয়কর বাবাদ ১২ হাজার ২৭৬ টাকা, একই সালের ৪ অক্টোবর শহরের জামে মসজিদ লেনের নূর এন্টারপ্রাইজ নামে ৫৯ হাজার ৩৫ টাকা, ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল মেসার্স খাজা প্রিন্টিং প্রেসের নামে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৫৩০ টাকা ও নিহার প্রিন্টিং প্রেসের নামে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৫৩০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

এভাবে আরও ২ কোটি ৪৩ লাখ ৭ হাজার ৮৭৮ টাকা লোপাট করা হয়েছে। এভাবে ৫ কোটি টাকা আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা সারাদেশে সমালোচনার ঝড় উঠে। কিন্তু এতো বড় দুর্নীতির অভিযোগের পরও বহাল তবিয়বে রয়েছেন বোর্ড চেয়ারম্যান, সচিবসহ অন্যরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। 

দুর্নীতি নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটিও প্রতিবেদন দেয়নি। অবশ্য তদন্ত কমিটির প্রধান যশোর শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক কেএম রব্বানী জানান, তদন্ত শেষ। তারা দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছেন। চলতি সপ্তাহে তারা প্রতিবেদন জমা দেবেন। এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আইন অনুসারে মামলা হওয়ার পর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে ও গ্রেফতার হলে তারা সাময়িক বরখাস্ত হবেন। এছাড়া দুর্নীতি তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অন্যদিকে, বোর্ডের চেয়ারম্যানের অপকর্ম উল্লেখ করে তাকে অপসারণে চলতি বছরের ২৫ আগস্ট যশোর-২ আসনের এমপি মেজর জেনারেল (অ.) নাসির উদ্দিন ও যশোর-৬ আসনের এমপি শাহীন চাকলাদার শিক্ষামন্ত্রীর কাছে ডিও লেটার দেন। কিন্তু মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

শিক্ষা বোর্ডের কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবলু অভিযোগ করেন, দুই সংসদ সদস্য ডিও লেটার দিলেও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন তিনি দুর্নীতির মামলার আসামি হয়েও স্বপদে রয়েছেন। ফলে সঠিক তদন্ত হবে কীনা সন্দেহ রয়েছে। আর বোর্ডের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তার অনিয়মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন।

এদিকে, দুদক মামলা করলেও এখনো তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ হয়নি। ফলে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা কথা। তারা আশঙ্কা করছেন বোর্ড চেয়ারম্যান তদবির করে আটকে দিয়েছেন তদন্ত কার্যক্রম।

জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন যশোর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত বলেন, বোর্ডের দুর্নীতির মামলার ফাইল দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পৌঁছে গেছে। সেখান থেকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে। আশা করছি চলতি মাসের যে কোনো দিন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ হবে।

জাহিদ হাসান/এমএএস