বাগেরহাট পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আরেফিন বাদলের বিরুদ্ধে নারী উদ্যোক্তার কাছে ঘুষ দাবির অভিযোগ উঠেছে। এমনকি নিয়ম বহির্ভূতভাবে সদর উপজেলার দশানী এলাকায় অবস্থিত মেসার্স সালমা প্লাস্টিক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। 

পরিবেশ পদকপ্রাপ্ত নারী উদ্যোক্তা সালমা বেগম অভিযোগ করে বলেছেন, ঘুষ না দেওয়ায় প্রায় দুই বছর ধরে আমার কারখানার পরিবেশগত ছাড়পত্র আটকে আছে। 

তবে ঘুষ দাবির বিষয়টি অস্বীকার করে বাগেরহাট পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আরেফিন বাদল বলেছেন, কারও কাছে ঘুষ বা অনৈতিক কোনো সুবিধা চেয়েছি তা প্রমাণ করতে পারলে চাকরি ছেড়ে চলে যাব। 

এদিকে অযথা হয়রানি থেকে মুক্তি ও এই কর্মকর্তার বিচারের দাবিতে পরিবেশ অধিদফতরে প্রায় এক বছর আগে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী নারী উদ্যোক্তা সালমা বেগম। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত ওই অভিযোগের কোনো সুরাহা করেনি পরিবেশ অধিদফতর। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অতিদ্রুত ছাড়পত্র দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন এই নারী উদ্যোক্তা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৩ সালে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নিয়ে সরকারি সকল নিয়ম মেনে দশানী মৌজায় ২ হাজার বর্গফুট জমির ওপর অব্যবহৃত পুরাতন প্লাস্টিক দিয়ে সুতো (প্লাস্টিকের সুতো বা পাতা সুতো) তৈরির কারখানা স্থাপন করেন সালমা বেগম নামে এক নারী। মেসার্স সালমা প্লাস্টিক কারখানা নামে প্রতিষ্ঠানটিতে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছিলেন তিনি। কিন্তু সালমার স্বামী আরমান শরীফের সঙ্গে স্থানীয় একটি পক্ষের বিরোধের জেরে তারা ২০১৯ সালের ডিসেম্বর সালমা প্লাস্টিক কারখানার বিরুদ্ধে বাগেরহাট পরিবেশ অধিদফতরে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিভিন্নভাবে নারী উদ্যোক্তা সালমাকে হয়রানি শুরু করেন বাগেরহাট পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আরেফিন বাদল। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অভিযোগের প্রেক্ষিতে তৎকালীন বাগেরহাট সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং পরিবেশ অধিদফতরের বাগেরহাট কার্যালয়ের বায়োকেমিস্ট নিখিল চন্দ্র ঢালি ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি সালমা প্লাস্টিক কারখানা পরিদর্শন করেন। একই মাসের ১৩ তারিখে সালমার প্রতিষ্ঠান দিয়ে কোনো দূষণ হয় না মর্মে প্রতিবেদন দেন বায়োকেমিস্ট নিখিল চন্দ্র ঢালি। কিন্ত ১৫ জানুয়ারি কারখানা ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠান বন্ধ অথবা স্থানান্তরের আদেশ দেন বাগেরহাট পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আরেফিন বাদল। ওই দিন সালমার স্বামী আরমান শরীফ উপ-পরিচালকের দ্বারস্থ হলে ২ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন তিনি। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ১৭ ফেব্রুয়ারি কারখানাটি আবাসিক এলাকায় অবস্থিত উল্লেখ করে কারখানা স্থানান্তরের জন্য আরও একটি নোটিশ প্রদান করেন এই কর্মকর্তা।

এই অবস্থার মধ্যেই সালমা প্লাস্টিক কারখানার পরিবেশগত ছাড়পত্রের মেয়াদ শেষ হলে ২০২০ সালের ২৪ মার্চ পরিবেশ অধিদফতরে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ সরকার নির্ধারিত ফি জমা দেন সালমা বেগম। কিন্তু ছাড়পত্র প্রদান না করে আবারও ঘুষ দাবি করেন ওই কর্মকর্তা। এর সঙ্গে  প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার নানা ধরনের হুমকি চলতে থাকে। ঘুষ না দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে একই বছর ৫ মে উপ-পরিচালকের নির্দেশে বায়োকেমিস্ট নিখিল চন্দ্র ঢালি সালমা প্লাস্টিক কারখানা সিলগালা করে দেন। পরবর্তীতে সালমা বেগমের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২১ জুন জেলা প্রশাসনের নির্দেশে আবার কারখানাটি চালু করা হয়। তারপরও পরিবেশ অধিদফতর থেকে সালমাকে ছাড়পত্র প্রদান না করে ১৩ আগস্ট পরিবেশ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে আদেশ অমান্য করে কারখানা খোলার অপরাধে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শুনানির নোটিশ দেওয়া হয়। 

পরবর্তীতে ১৮ আগস্ট পরিবেশ অধিদফতরের সদর কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট উইং শাখায় এই অভিযোগের শুনানি হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর শুনানির রায়ে প্রমাণিত হয় যে, পরিবেশ অধিদফতর বাগেরহাটের উপ-পরিচালক নিয়ম বহির্ভূতভাবে কারখানাটি বন্ধ করেছিলেন। এরপরও পরিবেশ অধিদফতর থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতা পাননি সালমা বেগম। একপর্যায়ে ৩১ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে উপ-পরিচালক আরেফিন বাদলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন তিনি। 

সালমা বেগমের স্বামী আরমান শরীফ বলেন, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ বলার পরে আমি পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালকের কাছে যাই। তিনি আমার কাছে দুই লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। আমি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। বেআইনিভাবে আমাদের কারখানা সিলগালা করে দেন। অনৈতিক সুবিধা আদায়ের পন্থা হিসেবে পরিবেশের ছাড়পত্র আটকে দেন তিনি। বাদল সাহেব আরও বলেছেন, ‘টাকা দিতে হবে আপনাদের, লাভতো কম করেন না।’ একজন সরকারি কর্মকর্তা আমাদের মতো উদ্যোক্তাদের এভাবে হয়রানি করলে কীভাবে ব্যবসা করব। 

হেলেনা বেগম নামে কারখানার এক নারী শ্রমিক বলেন, আমার স্বামী আগে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করতো। কিন্তু একটি দুর্ঘটনার পর পঙ্গু হয়ে যাওয়ায় ভ্যান নিয়ে বের হতে পারে না। আমার আয়েই সংসার চলে। কিন্তু মাঝে মাঝেই বড় স্যাররা এসে কারখানা বন্ধ করে দিয়ে যায়। তখন দুই মেয়ে আর স্বামী নিয়ে আমাদের অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হয়।

নারী উদ্যেক্তা সালমা বেগম বলেন, অব্যবহৃত ফেলে রাখা প্লাস্টিক কুড়িয়ে এনে কারখানায় ব্যবহার করি আমরা। এতে পরিবেশের অনেক উপকার হয়। এ কারণে ২০১৬ সালে আমি যৌথভাবে বিভাগীয় পরিবেশ পদকও পেয়েছি। এছাড়া কারখানায় ছয়জন হতদরিদ্র নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতরের স্বেচ্ছাচারিতায় বারবার আমার ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশের ছাড়পত্র না দেওয়ায় আমি স্বাভাবিকভাবে কারখানা চালাতে পারছি না। মাঝে মাঝেই পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা এসে আমার কারখানা বন্ধ করে দেন। 

ঘুষ দাবির বিষয়টি অস্বীকার করে বাগেরহাট পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আরেফিন বাদল বলেন, সালমা প্লাস্টিক কারখানা পরিবেশ দূষণ করছে- এলাকাবাসীর এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে কারখানা পরিদর্শন করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট সময় পার হলে ছাড়পত্র নবায়ন করতে আসেন সালমা বেগম। ভবন ঝুকিপূর্ণ ও কারখানার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় ছাড়পত্র প্রদান করা হয়নি। পরবর্তীতে নানা জটিলতায় পরিবেশ অধিদফতরের বিভাগীয় কার্যালয় থেকে সালাম প্লাস্টিক কারখানার ফাইল তলব করে নেওয়া হয়েছে। এখন এই প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে কি হবে না সে বিষয়ে বিভাগীয় কার্যালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।

তিনি আরও বলেন, আমি কারও কাছে এক টাকাও দাবি করিনি। আইনের বাইরে কোনো কাজও করিনি। দফতরের সিদ্ধান্ত কারও বিরুদ্ধে গেলে, তারা নানা ধরণের অভিযোগ করে থাকেন। এছাড়া আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছে সেটি প্রধান কার্যালয়ে তদান্তাধীন রয়েছে। তদন্ত শেষে আমাকে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

পরিবেশ অধিদফতরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক সাইফুর রহমান খান বলেন, ২০২০ সালের ২ জুলাই সালমা প্লাস্টিক কারখানার ফাইলটি মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো হয়েছে। এরপর থেকে আমাদের কাছে আর কোনো নির্দেশনা আসেনি।

তানজীম আহমেদ/আরএআর