পিয়ারুল ইসলাম

গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে রিকশাচালক ছকুকে রাতভর নির্যাতনের পর হত্যা মামলার আসামিরা সংবাদ প্রকাশের জেরে নিউজবাংলার গাইবান্ধা প্রতিনিধি ও প্রেসক্লাব গাইবান্ধার সহ-সাধারণ সম্পাদক পিয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন। মামলায় ছকু হত্যার বাদী ও সাক্ষীকেও আসামি করা হয়েছে।

বুধবার (৮ ডিসেম্বর) বিকেলে গাইবান্ধা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক আবদুর রহমান মামলাটি গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে আগামী বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়।

মামলার এজাহারে বলা হয়, চলতি বছরের ১৫ মে গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার পূর্ব দামোদরপুর গ্রামের মন্টু মিয়ার মেয়ে মনিকা আকতারকে (১৪) ছকু হত্যা মামলার বাদী মোজাম্মেল হক, সাংবাদিক পিয়ারুল ইসলাম, তার ছোট ভাই ওয়ারেস সরকার, চাচা আসাদুল ইসলাম, ছকু হত্যার পর আন্দোলনে অংশ নেওয়া একরামুল হক ও তার ছোট ভাই ইউসুপ আলী বাড়ির অদূরে একটি ব্রিজের সামনে থেকে অপহরণ করে। পরে মোজাম্মেল মেয়েটিকে ঢাকার গাজীপুরে নিয়ে আটকে একাধিকবার ধর্ষণ করে।

অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগ এনে মেয়েটির মা রিপা বেগম বাদী হয়ে গত ২৩ জুন রিকশাচালক  ছকু মিয়া হত্যা মামলার বাদী, সাক্ষী ও সাংবাদিকসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে গাইবান্ধা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এ মামলার আবেদন করেন।

গত ২৮ জুলাই মামলার আবেদনটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। পরে ৪ নভেম্বর তদন্ত শেষে দুইজনকে বাদ দিয়ে চারজনকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন জমা দেন গাইবান্ধা পিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই দীপংকর সরকার।

প্রতিবেদনে মোজাম্মেল হককে অপহরণ ও ধর্ষণে অভিযুক্ত করা হয়। এছাড়া বাকি তিনজনকে অপহরণের সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়।

মামলায় যাদের নাম বাদ পড়েছে তারা হলেন, পিয়ারুল ইসলামের ছোট ভাই ওয়ারেস সরকার ও একরামুল হকের ছোট ভাই ইউসুপ আলী। তবে ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। এছাড়া ছকু হত্যা মামলার ৯ আসামিই হয়েছেন ধর্ষণ ও অপহরণ মামলাটির সাক্ষী হিসেবে। বাকিরাও একই পরিবারের সদস্য।

ছকু হত্যা মামলার এজাহারে বলা হয়, গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার পূর্ব দামোদরপুর গ্রামের ছয় ভাই আলমগীর, আংগুর, রনজু, মনজু, সনজু ও মন্টু মিয়া দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় দাদনের কারবারে জড়িত। সুদের টাকায় তারা অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেছেন। তাদের সঙ্গে একই গ্রামের রিকশাচালক ছকু মিয়ার পারিবারিক ও দাদনের টাকা নিয়ে বিরোধ ছিল। ছকুর ছেলের সঙ্গে মন্টু মিয়ার মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে সেই বিরোধ আরও বাড়ে।

এ নিয়ে গত ১৫ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ছকু মিয়াকে তারই বাড়িতে আটকে হাত-পা বেঁধে রাখে ছয় ভাইসহ তাদের লোকজন। রাতভর ছকুর ওপর চলে অমানবিক নির্যাতন। এ সময় তার এক হাত ও একটি দাঁত ভেঙে যায়। এ ছাড়া তার গোপনাঙ্গে আঘাত করা হয়। পরদিন ১৬ মে সকাল থেকেই ছকু মিয়ার বাড়িতে তাকে জিম্মি করে রাখা হয়। পরে পরিবারের লোকজন তাকে হাসপাতালে নিতে চাইলে ছকুর দুই ভাই মহাব্বর ও জহিরকে মারপিট করা হয়। পরে গ্রামবাসীও ছকুকে হাসপাতালে নিতে পারেনি।

ওই দিন দুপুরে স্থানীয় সংবাদকর্মী পিয়ারুল ইসলাম ঘটনাটি জানার পর ৯৯৯ এ ফোন করলে বিকেল ৫টার দিকে অভিযোগ পেয়ে পুলিশ ছকুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে তিনদিন চিকিৎসা করার পর আসামিদের ভয়ে পালিয়ে বোনের বাড়িয়ে আশ্রয় নেয় ছকু।

এক সপ্তাহ পর ছকুকে সেখান থেকে ধরে এনে দামোদরপুর ইউপি চেয়ারম্যান এজেএম সাজেদুল ইসলাম স্বাধীনের উপস্থিতিতে সালিশ বৈঠকে ‘ছেলের প্রেমের খেসারত’ হিসেবে ছকু মিয়াকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সেই টাকার জন্য ছকুর একমাত্র ঘরটিও ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন দাদন কারবারিরা। এরপর তাকে ভিটেছাড়া করা হয়। পরে ছকু মিয়া আশ্রয় নেন গাজীপুরের শ্রীপুরে ছেলের বাসার। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩ জুন মৃত্যু হয় তার।

গ্রামবাসী ও নিহত ছকু মিয়ার পরিবার জানায়, ছকুর মৃত্যুর পর ছেলে মোজ্জাম্মেল ও মেয়ে ছোমেলা খাতুন মরদেহ নিয়ে সাদুল্লাপুর আসেন ওই রাতেই। রাতভর মোজাম্মেলসহ তার পরিবার সাদুল্লাপুর থানায় মামলা করতে চাইলে পুলিশ মামলা গ্রহণ করেনি।

পরে আসামিরা স্থানীয় চেয়ারম্যান এজেএম সাজেদুল ইসলাম স্বাধীনের মাধ্যমে মীমাংসার প্রস্তাবের আশ্বাস দিয়ে মরদেহ বাড়িতে নিয়ে যায়। পরদিন ৪ জুন ছকুর ছেলে মোজ্জাম্মেল ও তার ছোট বোন ছমেলা খাতুনকে ঘরবন্দী করে চেয়ারম্যানের উপস্থিতে তারা মরদেহ দাফন করে। দাফনে মোজাম্মেলসহ পরিবারের কাউকেই অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।

দাফন শেষে ওই দিনই মোজাম্মেল ও তার বোনকে গ্রামছাড়া করে দাদন কারবারিরা। পরে ছমেলা পার্শবর্তী শ্রীকলা গ্রামের মামা মুসা মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন। এ ছাড়া মোজাম্মেল যান আত্মগোপনে। কয়েকদিন পর মোজাম্মেল পার্শ্ববর্তী উত্তর মরুয়াদহ গ্রামের কৃষক আবদুর রাজ্জাকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। বর্তমানে সেই বাড়িতে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় খেয়ে না খেয়ে বসবাস করছেন তিনি।

পরবর্তীতে এ ঘটনায় থানায় মামলা না নিলে গত ১৬ জুন ছকু মিয়ার ছেলে মোজাম্মেল হক জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে (সাদুল্লাপুর) মামলা করেন। পরে আদালতের বিচারক শবনম মুস্তারী সাদুল্লাপুর থানাকে মামলা রেকর্ডভুক্ত করে ২৩ জুনের মধ্যে মরদেহ উত্তোলনসহ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। মামলার পর মোজাম্মেলকে সেখানেও বিভিন্ন হুমকি দিয়ে আসছে আসামিরা।

এ সব ঘটনায় মামলা ছাড়াও নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি ও আদালতে একটি মামলাও (৭ ধারা) করেন তিনি। যা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

গত ২১ জুন সাদুল্লাপুর থানার পুলিশ ও জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লোকমান হোসেনের উপস্থিতিতে মরদেহ তুলে ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। তবে ময়নাতদন্তের ফরেনসিক রিপোর্ট এখনো আদালতে আসেনি।

এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলাটি জেলাজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। গ্রামবাসী, ইউনিয়ন ও উপজেলাবাসীর ব্যানারে মানববন্ধনসহ বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। 

রিপন আকন্দ/আরএআর