মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত শত্রুজাহাজ এমভি আকরাম (লোরাম)-এর ভগ্নাংশ

অবশেষে চাঁদপুরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্মৃতিবিজড়িত শত্রুজাহাজ এমভি আকরাম (লোরাম) ফিরিয়ে এনে এখানে একটি রিভার মিউজিয়াম (নৌ-জাদুঘর) স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। পর্যটনকেন্দ্রের আদলে ডাকাতিয়া নদীর তীরে সেই জাদুঘর স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

জাদুঘরের স্থান নির্ধারণের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ মামুনুল আলমের নেতৃত্বে সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ইতিমধ্যে স্থানটি পরিদর্শন করে গেছে।

এদিকে বেশ কয়েক বছর ধরে শত্রুজাহাজটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন চাঁদপুরের মুক্তিযোদ্ধারা। সেই সঙ্গে দেশের নৌ-জাদুঘরটিও চাঁদপুরে করার দাবি করেন তারা। এমন দাবিতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। তাদের দাবি, যেখানে জাহাজটি ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আগামী ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে সেখানেই এটি সংরক্ষণ করা হোক। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম গর্ব করে বলতে পারে এবং দেখাতে পারে তাদের পূর্বপুরুষের বীরত্বের কথা।

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের সময় নৌ-কমান্ডো বাহিনী মধ্য আগস্ট থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ নৌ-বন্দরসহ বাংলাদেশের সমগ্র জলপথে লিমপেট মাইনের সাহায্যে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর অর্থ ও অস্ত্র বহনকারী ১২৬টি জাহাজ গভীর পানিতে ডুবিয়ে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৭১-এর ৩০ অক্টোবর গভীর রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে সাবমেরিনার শেখ আমানউল্লা বীর বিক্রমের অধীনের চাঁদপুরের নৌ-কমান্ডোরা লিমপেট মাইনের সাহায্যে ডাকাতিয়া নদীর লঞ্চঘাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র বহনকারী এমভি ইকরামকে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

যুদ্ধকালীন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী অনেক চেষ্টা করে জাহাজটি উত্তোলন করে নদী বন্দর সচল করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সরকার জাহাজটি উদ্ধারকারী এমভি হামজা ও এমভি রুস্তমের সাহায্যে ডুবন্ত জাহাজটিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৯৮২ সালে শিল্প মন্ত্রণালয় নিলামের মাধ্যমে জাহাজটি বিক্রি করে। কিন্তু নিলামের মাধ্যমে ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান জাহাজটি অনেক চেষ্টা করে পানির নিচ থেকে ওঠাতে ব্যর্থ হয়।

২০০৮ সালের ৯ অক্টোরব ডাকাতিয়া নদীর তলদেশ থেকে জাহাজটি তুলে নিয়ে নিলামে বিক্রি করে দিলে চাঁদপুরের সচেতন মহল আন্দোলন শুরু করে। বর্তমানে জাহাজটি নারায়ণগঞ্জের একটি ডকইয়ার্ডে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে।

চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্মৃতিবিজড়িত এমভি আকরাম যুদ্ধজাহাজটি চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে সংরক্ষণ করা এবং এখানে একটি জাদুঘর করতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ মামুনুল আলমের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলটি প্রাথমিকভাবে শুধু জায়গা নির্বাচন করতে এসেছে। তারা ডাকাতিয়া নদীর তীরবর্তী স্থান পরিদর্শন করেছে। এরপরই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে কবে নাগাদ এটি চাঁদপুরে আনা হবে, এমন কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের জনসাধারণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে এমভি ইকরাম জাহাজটির মালিকের দাবি পরিশোধ ও জাহাজটি সংরক্ষণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় দুই কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। বরাদ্দের অর্থ থেকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ১ কোটি ৯ লাখ ৫ হাজার টাকা মেসার্স মোক্তার হোসেন অ্যান্ড রফিকুল ইসলামকে পরিশোধ করে। অবশিষ্ট ৯০ লাখ ৯৫ হাজার টাকা এমভি ইকরাম জাহাজটি সংরক্ষণের ব্যয়ের জন্য গচ্ছিত রাখা হয়।

হানাদার বাহিনীর অস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘এমভি আকরাম’ (ছদ্মনাম লোরাম) বর্তমানে নতুন প্রজন্মের কাছে পূর্বপুরুষের বীরত্বগাথা হিসেবে চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে নৌ-জাদুঘর করে সংরক্ষণ করা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।


শরীফুল ইসলাম/এনএ