৩৬ বছর পর বাড়ি ফিরলেন হাসিনা, শোনালেন জীবনের করুণ গল্প
হাসিনা খাতুন
হারিয়ে যাওয়ার দীর্ঘ ৩৬ বছর পর নিজ বাড়িতে ফিরেছেন হাসিনা খাতুন (৪৬) নামে এক নারী। দীর্ঘদিন পর স্বজনদের ফিরে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন তিনি। মাত্র ১০ বছর বয়সে হারিয়ে গিয়েছিলেন হাসিনা খাতুন। শনিবার (৩০ জানুয়ারি) তিনি নাটোরের বড়াইগ্রাম পৌরসভার রয়না গ্রামে তার বাবা মৃত মখলেছুর রহমানের বাড়িতে ফিরে এলে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে তাকে এক নজর দেখার জন্য ভিড় জমায় উৎসুক জনতা। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে অবশেষে স্বজনদের কাছে ফিরলেন হাসিনা।
স্বজনরা জানান, আগে থেকেই সহজ-সরল হাসিনার স্মৃতিশক্তি একটু দুর্বল ছিল। কোনো কিছু ঠিকঠাক মনে রাখতে পারতেন না। প্রায় ৩৬ বছর আগে একদিন হাসিনা কাউকে কিছু না বলে তার প্রতিবেশী এক নানির সঙ্গে বনপাড়া বাজারে যান। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
বিজ্ঞাপন
এ বিষয়ে হাসিনা খাতুন ঢাকা পোস্টকে জানান, তিনি সেদিন বনপাড়া বাজার থেকে বাড়ি ফেরার জন্য একাই বাসে ওঠেন। তবে ভুল বাসে ওঠায় চলে যান ঈশ্বরদী। পরে যান ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনে। কিন্তু ফিরবেন কীভাবে বুঝতে না পেরে বসে বসে কাঁদছিলেন। এ সময় আলমগীর হোসেন নামে রেলওয়ের একজন টিটি তাকে দেখতে পেয়ে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। কিছুদিন চেষ্টা করেও তার পরিচয় জানতে না পেরে পরে হাসিনার আশ্রয় মেলে আলমগীরের দুলাভাই কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার কলাবাড়িয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে।
এরপর তারাই লালন-পালন করে গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেন। কিন্তু দীর্ঘ ১২ বছরেও কোনো সন্তান না হওয়ায় একপর্যায়ে ভেঙে যায় সেই সংসার। এরপর হাসিনার পুনরায় বিয়ে হয় কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ভাদালিয়া গ্রামের বাসিন্দা কুষ্টিয়া চিনিকলের পাওয়ার টারবাইন অপারেটর হিসেবে কর্মরত আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে।
বিজ্ঞাপন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসিনা খাতুনের সঙ্গে আসা সোহেল রানা জানান, হাসিনার বর্তমান স্বামী সম্পর্কে তার দুলাভাই। বিয়ের পর তিনি (হাসিনা) প্রায়ই বাবা-মাকে দেখতে চাইতেন। কিন্তু ঠিকানা বলতে পারতেন না। তবে বাড়ি লক্ষ্মীকোল, বাবার নাম মখলেছ আর বাড়ির পাশে বড়াল নদী আছে শুধু এতটুকুই বলতে পারতেন। গত তিন বছরে এটুকু তথ্যের ভিত্তিতেই সোহেল রানা ও তার দুলাভাই হাসিনার স্বজনদের খুঁজে পেতে নাটোরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছেন। কিন্তু খোঁজ মেলেনি।
অবশেষে গত ১৭ দিন আগে তারা বড়াইগ্রাম পৌরসভার লক্ষ্মীকোলের পাশে রয়না গ্রামে এসে খুঁজে পান তাদের ঠিকানা। এরপর গত শনিবার তারা হাসিনাকে নিয়ে আসেন স্বজনদের কাছে। কিন্তু ইতোমধ্যে হাসিনার বাবা মখলেছুর রহমান ও সৎমা দুজনেই মারা গেছেন। রয়েছে শুধু তার ছোট দুই বোন আর বাড়ি সংলগ্ন মামি ও মামাতো ভাই-বোনেরা। শনিবার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িতে ফিরে কান্নায় ভেঙে পড়েন হাসিনা। দীর্ঘদিন পর তাকে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরাও। বাবা-মায়ের স্মৃতি আর স্বজনদের নিয়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন পেলেন হাসিনা খাতুন।
হাসিনার মামাতো ভাই আমজাদ হোসেন বলেন, দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় আমরা বোনকে এক প্রকার ভুলতেই বসেছিলাম। আর কোনো দিন তাকে পাবো এমন আশা ছিল না। কিন্তু অবশেষে তাকে পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।
হাসিনা খাতুন বলেন, সব সময়েই বাবা-মাসহ স্বজনদের দেখতে ইচ্ছা করতো, কিন্তু বাড়ির ঠিকানা সঠিকভাবে বলতে না পারায় শুধু নীরবে কেঁদেছি। স্বামীর চেষ্টায় অন্তত তাদের মুখ দেখতে পেরেছি এতেই আমার কলিজা ঠান্ডা হয়েছে। এখন এটুকু ভেবে শান্তি পাচ্ছি যে, পৃথিবীতে আমারও আপন বলে কেউ আছে।
তাপস কুমার/আরএআর