ঋণ পরিশোধ না করেও ভালো গ্রাহক
ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের লোগো
বছরের পর বছর ঋণের কিস্তি বকেয়া, পরিশোধের খবর নেই! সুদে-আসলে দেনা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুন। তারপরও খেলাপি নয়, ‘ভালো’ গ্রাহকের তালিকায় নাম। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের কোম্পানি ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের অভ্যন্তরীণ ঋণমান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
প্রতিষ্ঠানটি প্রায় শতাধিক গ্রাহকের খেলাপি ঋণ নবায়ন (পুনঃতফসিল) করে কৌশলে স্ট্যান্ডার্ড বা অশ্রেণি করে রেখেছে। এতে কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক বিবরণী ভালো হলেও বাস্তবে ভিন্ন চিত্র।
বিজ্ঞাপন
ফিনিক্স ফাইন্যান্স থেকে ২০১০ সালে ১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল বেঞ্জ ইন্ডাস্ট্রি বিডি লিমিটেড। ১০ বছরে ঋণের পরিমাণ না কমে উল্টো বেড়েছে। এখন সুদ-আসলে ঋণের পরিমাণ দ্বিগুনের চেয়েও বেশি অর্থাৎ ২২ কোটি ২৪ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখনও প্রতিষ্ঠানটির ঋণমান স্ট্যান্ডার্ড অর্থাৎ ভালো মানের। কারণ খেলাপি না করে উল্টো বেঞ্জ ইন্ডাস্ট্রি বিডিকে তিনবার পুনঃতফসিল সুবিধা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পুনঃতফসিল করে মন্দ ঋণকে অনেক কম দেখানো হচ্ছে। কিন্তু সত্যিকারার্থে কি মন্দ ঋণ কমছে? এটি করে কাগজে-কলমে ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট ভালো দেখাচ্ছে। যা কখনও সুফল আনবে না।’
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, ‘ব্যবসা করার সময় সমস্যা হয়। এ কারণে বিভিন্ন সময় ঋণ পুনর্গঠন, পুনঃতফসিল ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু এ সুবিধা যদি ঢালাওভাবে দেওয়া হয়, তবে সমস্যা। একই প্রতিষ্ঠানকে বারবার সুবিধা দেওয়া মোটেও ঠিক নয়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও যথাযথ ভূমিকা নেয় না। এ সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে হবে। ঋণ আদায়ে কঠোর ও সতর্ক হতে হবে। তা না হলে এসব প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতে বিপদে পড়বে।’
ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ঋণমান প্রতিবেদন তথ্য বলছে, ঋণ শোধ না করে বারবার নবায়নের সুবিধা নিচ্ছে প্রতিষ্ঠান পদ্মা পলিকটন নিট ফেব্রিক্স। প্রতিষ্ঠানটি ফিনিক্স ফাইন্যান্স থেকে ২০০৮ সালে ১০ কোটি টাকা ঋণ নেয়। ১২ বছর পার হয়েছে কিন্তু কমেনি ঋণের অঙ্ক, উল্টো বেড়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে পদ্মা নিটের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৪০ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ সময়ে দুবার ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের ৩১ অক্টোবর তৃতীয়বারের মতো ঋণটি পুনঃতফসিল করা হয়। কিন্তু এরপর থেকে এখন পর্যন্ত এক টাকাও পরিশোধ করেনি পদ্মা নিট। শুধু তাই নয়, ২০০৬ থেকে শুরু করে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১০ বার ঋণ দিয়েছে ফিনিক্স। কিন্তু একই অবস্থা সব ঋণের ক্ষেত্রে।
হিসাব পর্যালোচনা করে করে দেখা গেছে, ফিনিক্স ফাইন্যান্স আলোচিত সময়ে পদ্মা পলিকটনকে সবমিলিয়ে ২৭ কোটি ৯ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। ২০১৯ সাল শেষে সুদে-আসলে দেনার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা। গত বছর করোনায় সরকার ঘোষিত নীতিগত সহায়তায় তাদের ঋণগুলো এখন ‘ভালো ঋণ’র তালিকায়।
সেন্টার ফর অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকশন (প্রাইভেট) লিমিটেড পাঁচ কোটি টাকার ঋণ নেয় ২০০৯ সালে। তবে ঋণটির বর্তমান স্থিতি আট কোটি চার লাখ টাকা। একই প্রতিষ্ঠানকে ২০১০ সালে আরও পাঁচ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ দেয় ফিনিক্স ফাইন্যান্স। সেটাও পড়ে আছে বাকির খাতায়। এখন তার পরিমাণ গিয়ে ঠেকেছে ১২ কোটি ৯৯ লাখ টাকায়। ২০১৯ সালে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ঋণগুলোকে সচল করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু মূল ঋণের দ্বিগুন টাকা এখনও পরিশোধের বাকি।
এ তালিকায় আরও রয়েছে কেয়ার স্পেশালাইজড হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার। ২০১১ সালে তাদের নেওয়া ঋণ এখন সুদে আসলে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকায়। কিন্তু মাত্র ১৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল হাসপাতালটি। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট ঋণটি পুনঃতফসিল করা হয়। দ্বিতীয় পুনঃতফসিলের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো টাকাই পরিশোধ করেনি তারা। কিন্তু বছর শেষে (২০১৯) তাদের ঋণকে দুটি স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে চিহ্নিত করেছে ফিনিক্স ফাইন্যান্স।
২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ২৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল নিউ অটো গ্যালাক্সি। ২০১৯ সাল শেষে তাদের দেনা-পাওনার হিসাব দাঁড়িয়েছে ৩০ কোটি ৯০ লাখ টাকায়। ২০১৭ সালের ৯ অক্টোবর ওরিয়েন্টাল রিয়েল এস্টেট লিমিটেডকে ৪৪ কোটি টাকা ঋণ দেয় ফিনিক্স ফাইন্যান্স। কিন্তু সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, এখন ফিনিক্স ফাইন্যান্সের পাওনা ৫৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
ঢাকা হাইড অ্যান্ড স্কিন লিমিটেড ২৫ কোটি টাকার ঋণ নেয় ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। কিন্তু সুদে-আসলে সেই টাকার পরিমাণ এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ কোটি ৮০ লাখ টাকায়।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ড লিমিটেডকে ২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা ঋণ দিলে এর পরিমাণ এখন তা বেড়ে ৬৬ কোটি ১০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
ওপেক্স গার্মেন্টস লিমিটেড ২০১৬ সালে ৩০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। চার বছর ঋণ না কমে বেড়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ওপেক্স গার্মেন্টসের দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ কোটি ৬৮ লাখ টাকায়।
২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল ফিনিক্স ফাইন্যান্স থেকে ৩০ কোটি টাকা ঋণ নেয় বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। তিন বছর পার হয়ে গেলেও দেনার পরিমাণ না কমে উল্টো বেড়েছে। ২০১৯ সাল শেষে প্রতিষ্ঠানটির ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।
এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির ঋণগ্রহীতার তালিকায় রয়েছে- প্যারাডাইস কেবলস লিমিটেড, এসবিএস কেবলস লিমিটেড, ইন্ট্রাকো প্রপার্টিজ লিমিটেড, ইন্ট্রাকো ডেভেলপারস লিমিটেড, মেসার্স আলী স্টিল এন্টারপ্রাইজ, গিভনেস স্পিনিং মিলস লিমিটেড, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, রাইজিং স্টিল লিমিটেড, ক্রিয়েটিভ আই, আর আর সুয়েটারস লিমিটেডসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি।
খাতসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রায় ১৩ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করছেন এস এম ইন্তেখাব আলম। প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এমডি বলেন, ঋণ পুনঃতফসিল নিয়মনীতি মেনেই করা হয়েছে। আইনের বাইরে কিছুই করা হয়নি। এছাড়া ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে বলেও তিনি জানান।
এসআই/আরএইচ/এফআর