>> খেলা‌পি ঋণ ১০ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা

>> সংকটাপন্ন অন্তত ডজন খানেক প্রতিষ্ঠান

>> মোট ঋণের ১৫ শতাংশ হয়েছে খেলাপি

পর্ষদ সদস্য‌দের লুটপাট আর নানা অব্যবস্থাপনায় নিমজ্জিত দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই)। বিতরণ করা ঋণ সময় মতো আদায় হ‌চ্ছে না। ফ‌লে ক‌রোনার ক্ষ‌তি পু‌ষি‌য়ে নি‌তে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার পরও বে‌ড়ে‌ছে খেলাপি ঋণের প‌রিমাণ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে (২০২০) শে‌ষে এনবিএফআই’র খেলাপি ঋণ দাঁড়ি‌য়ে‌ছে ১০ হাজার ২৪৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১৫ শতাংশ। আগে জুন প্রান্তিকে মোট খেলাপি ছিল মোট ঋণের ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বহুদিন ধরে আস্থাহীনতায় ভুগছে এ খাত। প্রধান কারণ গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারা। পিপলস লিজিং অবসায়নের পর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। শুধু পিপলস নয়, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার করণে সংকটাপন্ন অন্তত ডজন খানেক প্রতিষ্ঠান। এগুলোর অবস্থা দিনের পর দিন খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছ‌রের সে‌প্টেম্বর শে‌ষে দে‌শের ৩৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান মোট ৬৬ হাজার ২১৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করে। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১০ হাজার ২৪৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। হিসাব করে দেখা গেছে, আগের (২০১৯) বছরের একই সময়ের তুলনায় খেলাপি বৃদ্ধির হার ৪৯ দশমিক ৮০ শতাংশ।

মহামা‌রি করোনাভাইরাসের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণগ্রহীতাদের ঋণ শোধ না করার বিষয়ে বিশেষ সুবিধা দি‌য়ে‌ছে‌ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২০ সা‌লের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধ না করলেও খেলাপি হবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ‘ঋণ, লিজ, অগ্রিম শ্রেণীকরণ’ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করে এ সু‌বিধা দেয়

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কী মানের, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালের ১৭ জুন বিশেষ সফটওয়্যার চালু করে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর মতো এসব প্রতিষ্ঠানকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। প্রথম তালিকার প্রতিষ্ঠানগুলো থাকছে সাধারণ (সবুজ) শ্রেণিতে। এর পরের ধাপের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয় দুর্বল (হলুদ)। তৃতীয় ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমস্যাগ্রস্ত (লাল) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গত সেপ্টেম্বরে প্রথম ক্যাটাগরিতে পাঁচটি, দ্বিতীয় ধাপে ১৭টি ও তৃতীয় ধাপে ১২টি প্রতিষ্ঠান ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক | ফাইল ছবি

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, লাল তালিকায় থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে হয়েছে বিআইএফসি, এফএএস ফাইন্যান্স, ফার্ষ্ট ফাইন্যান্স, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, হজ ফাইন্যান্স, আইডিসিওএল, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, আইআইডিএফসিএল, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, প্রিমিয়ার লিজিং ও প্রাইম ফাইন্যান্স। 

এ মুহূর্তে পরিচালনা খরচ কমানোর দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। কারণ আমানত ও ঋণের সুদহারের পার্থক্য অর্থাৎ স্প্রেড-টা অনেকখানি কমে গেছে। সীমিত আয়ের মধ্যে খরচ সমন্বয় করা খুব কঠিন। এসবের মধ্যেও মুনাফা করতে হবে

গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া, ভাইস চেয়ারম্যান, বিএলএফসি

তবে এ খাতে সবই খারাপ নয়। আইডিএলসি, আইপিডিসি, আইআইডিএফসি, ইসলামিক ফাইন্যান্স, লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের মতো বেশকিছু ভালো প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসি) ভাইস চেয়ারম্যান ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানির (আইআইডিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত বিশেষ সুবিধার পর খেলাপি ঋণ বাড়ার কোনো কারণ নেই। তারপরও করোনার আঘাতে পুরো অর্থনৈতিক চাপ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়েছে।

তিনি বলেন, এ মুহূর্তে পরিচালনা খরচ কমানোর দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। কারণ আমানত ও ঋণের সুদহারের পার্থক্য অর্থাৎ স্প্রেড-টা অনেকখানি কমে গেছে। সীমিত আয়ের মধ্যে খরচ সমন্বয় করা খুব কঠিন। এসবের মধ্যেও মুনাফা করতে হবে। সব বাধা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে সামনে এগোতে হবে।

যেখানে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি তৈরি হচ্ছে এবং পরিচালকদের যোগসাজশে টাকা বের করে নেওয়া হচ্ছে, তদন্তের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে

মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্ট‌কে বলেন, আর্থিক খাতও আমাদের অর্থনীতির একটি বড় অংশ। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে খেলাপি বৃদ্ধি পাওয়া এ খাতের জন্য মোটেও সুখকর নয়। এতে পুরাতনদের পাশাপাশি পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। 

তিনি আরও বলেন, ‘করোনার কারণে ঋণখেলাপিদের নানা রকম সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যাহত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুঁজিবাজার ও মুদ্রাবাজার। যেখানে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি তৈরি হচ্ছে এবং পরিচালকদের যোগসাজসে টাকা বের করে নেওয়া হচ্ছে, তদন্তের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।’

মহামা‌রি করোনাভাইরাসের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণগ্রহীতাদের ঋণ শোধ না করার বিষয়ে বিশেষ সুবিধা দি‌য়ে‌ছে‌ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২০ সা‌লের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধ না করলেও খেলাপি হবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ‘ঋণ, লিজ, অগ্রিম শ্রেণীকরণ’ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করে এ সু‌বিধা দেয়।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যতসংখ্যক কিস্তি বকেয়া থাকবে সমসংখ্যক কিস্তি বাড়িয়ে ঋণ আদায় করবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তবে এ সময়ে কোনো দণ্ড, সুদ বা অতিরিক্ত ফি নেওয়া যাবে না বলে সর্বশে‌ষে গত ১ ন‌ভেম্বর নির্দেশনায় জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এসআই/এমএআর