প্রতীকী ছবি

খু‌দে শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ে উৎসাহিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে চালু হয়েছিল স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যেমন উপকৃত হচ্ছে, তেমনি বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানতের পাল্লাও ভারি হচ্ছে। সঞ্চিত টাকা বিনিয়োগ হয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।

কিন্তু শিশুদের কর চিহ্নিত নম্বর তথা টিআইএন না থাকায় বাড়তি কর দিতে হচ্ছে হিসাবধারীদের। অতিরিক্ত করারোপের কার‌ণে বাচ্চাদের ব্যাংক হিসাবে টাকা রাখতে আগ্রহ হারাচ্ছেন অভিভাবকরা। তাই শিক্ষার্থীদের ব্যাংক হিসাবে আয়কর কম কাটার প্রস্তাব দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নিয়ম অনুযায়ী, যেসব ব্যাংক হিসাবধারীর টিআইএন আছে তাদের আমানতের সুদ বা মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ কর কর্তন করে রাজস্ব খাতে জমা দেয় ব্যাংকগুলো। কিন্তু যাদের টিআইএন নেই তাদের অর্জিত মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ কর কর্তন করে। স্কুল ব্যাংকিংয়ের হিসাবধারীরা ১৮ বছরের কম বয়স হওয়ার তাদের টিআইএন নেই। তাই স্কুল ব্যাংকিং‌য়ের হিসা‌বধারীদের আমানতের মুনাফার ওপর বাড়‌তি হা‌রে কর কর্তন করা হ‌চ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক হিসেবে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের বর্তমান আমানতের ওপর পাঁচ কোটি ৪৬ লাখ ৪২ হাজার টাকা আয়কর নিয়েছে ব্যাংগুলো। টিআইএন থাকলে এই কর কর্তনের হার অনেক কম হতো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিরিক্ত আয়কর কর্তনের প্রভাবে কমে আসতে পারে স্কুল শিক্ষার্থীদের ব্যাংকে টাকা জমানোর অভ্যাস। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর)। এতে করহার কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ছাত্র/ছাত্রীদেরকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনয়নের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং তাদেরকে আধুনিক ব্যাংকিং সেবা ও প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী তফসিলি ব্যাংকসমূহ স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

এ সম্পর্কিত বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জারি করা নীতিমালা অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীরা জন্ম নিবন্ধন সনদ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র/প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্র/সর্বশেষ মাসের বেতন রশিদের সত্যায়িত অনুলিপির মাধ্যমে স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খুলতে পারে।

আইনগতভাবে অভিভাবকের মাধ্যমে হিসাবটি পরিচালনা করতে হয়। এক্ষেত্রে ছাত্র/ছাত্রীদের পক্ষে পিতা-মাতা অথবা সাধারণত পিতা-মাতা অথবা আইনগত অভিভাবক থেকে প্রাপ্ত অর্থ/বৃত্তি উপবৃত্তির অর্থ এ ধরনের হিসাবে জমা হয় এবং হিসাবের মূল সুবিধাভোগী ও হিসাবধারীর পিতা/মাতা অথবা আইনগত অভিভাবক এছাড়া, অপ্রাপ্তবয়স্ক বিধায় হিসাবধারীর কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র ও ১২ অঙ্কের ই-টিআইএন থাকে না।

আয়কর অডিন্যান্স, ১৯৮৪ এর সেকশন ৫৩ (এফ) অনুযায়ী ব্যাংকে রক্ষিত আমানতের সুদ/মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ অথবা ১২ অংকের ই-টিআইএন থাকা সাপেক্ষে ১০ শতাংশ হারে উৎসে আয়কর (এআইটি) কর্তন করতে হয়। যেহেতু, স্কুল ব্যাংকিং হিসাবধারীরা অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং তাদের কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র ও ই-টিআইএন সার্টিফিকেট নেই, এ কারণে উক্ত বিধান অনুযায়ী তাদের হিসাব হতে ব্যাংকসমূহ ১৫ শতাংশ হারে উৎসে আয়কর কর্তন করা হচ্ছে মর্মে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়েছে।

তবে স্কুল ব্যাংকিং হিসাবধারী ছাত্র/ছাত্রীদের পিতা/মাতা/আইনগত অভিভাবকরা তাদের ই-টিআইএন বিবেচনায় নিয়ে এরূপ হিসাবের বিপরীতে অর্জিত সুদ/মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ আয়কর কর্তনের জন্য ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ করছে মর্মেও ব্যাংক হতে জানা গেছে। এক্ষেত্রে, হিসাবধারীর পিতা/মাতা অথবা আইনগত অভিভাবক, যাদের মাধ্যমে হিসাব পরিচালিত হয়, তাদের ১২ অঙ্কের ই-টিআইএনকে বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থীদের সুদের ওপর আয়করের পরিবর্তন আনার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

স্কুল ব্যাংকিং হিসাব কার্যক্রমটি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্র/ছাত্রীদেরকে ব্যাংকিং সুবিধার আওতায় আনার মাধ্যমে তাদের মধ্যে সঞ্চয়ী মনোভাব তৈরিতে স্কুল ব্যাংকিং প্রকল্প বাস্তবায়নে যথাযথ ও ইতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলছে। আমানতের সুদ/মুনাফার ওপর ১০ শতাংশের পরিবর্তে ১৫ শতাংশ হারে উৎসে আয়কর কর্তন অব্যাহত থাকলে ছাত্র/ছাত্রীদের অভিভাবকরা উক্ত জমাকৃত অর্থ স্কুল ব্যাংকিং হিসাবে জমা না করে নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে জমাকরণে উৎসাহিত হবেন।

সেক্ষেত্রে অভিভাবকদের যেহেতু ই-টিআইএন রয়েছে সেহেতু উৎসে আয়কর ১০ শতাংশ হারেই প্রদেয় হবে।‌ ফলে, স্কুল ব্যাংকিং হিসাব কার্যক্রমটি বাধাগ্রস্ত হবে এবং ছাত্র/ছাত্রীদের সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ার উদ্দেশ্যও ব্যাহত হবে।

বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে যে সকল অভিভাবকের ১২ অঙ্কের ই-টিআইএন রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে উৎসে আয়কর ১০ শতাংশ নির্ধারণ এবং যে সকল অভিভাবকের নিজের কোনো ই-টিআইএন নেই তাদের ক্ষেত্রে উৎসে আয়কর ১৫ শতাংশ নির্ধারণের বিষয়টি বিবেচিত হতে পারে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে। এ বিষয়ে এনবিআরকে মতামত প্রদানের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস শেষে শিক্ষার্থীদের মোট অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ২৪ লাখ ৫০ হাজার ৫৬৪টি। স্কুল ব্যাংকিং হিসাবে শিক্ষার্থীদের জমাকৃত টাকার পরিমাণ এক হাজার ৮২১ কোটি ৪০ লাখ। আমানত ও হিসাবের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বেসরকারি খাতের ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড।

বিভিন্ন ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্কুল ব্যাংকিং আমানতের গড় সুদহার দুই শতাংশ। এতে বছরে ৩৬ কোটি ৪২ লাখ ৮০ হাজার টাকা সুদ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এই সুদের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়করের পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ কোটি ৪৬ লাখ ৪২ হাজার টাকা। শিক্ষার্থীদের টিআইএন না থাকায় প্রতিবছর এ পরিমাণ আয়কর গুনছে শিশু সঞ্চয়ীরা। হিসাব অনুযায়ী সেপ্টেম্বর শেষে অ্যাকাউন্টের পরিমাণ বেড়েছে ০.৭৮ শতাংশ এবং আমানত বেড়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ।

এসআই/এফআর