২ হাজার কোটি টাকার খোঁজে তিন বছরের নথি তলব
অজানা উৎস থেকে ইসলামী ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে জমা হওয়া দুই হাজার কোটি টাকা খোঁজে ব্যাংকটির ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত জমাকৃত অর্থ, প্রাপ্তির উৎস ও দাতা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
একই সঙ্গে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কি পরিমাণ অর্থ আদায়, অনাদায়ী কিংবা সমন্বয় হয়েছে তারও বিবরণ চেয়েছে দুদকের অনুসন্ধান টিম।
বিজ্ঞাপন
বুধবার (২০ জানুয়ারি) ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা বরাবর পাঠানো চিঠিতে এমন ৬ ধরনের নথিপত্র চাওয়া হয়েছে। যা আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
অনুসন্ধান টিম প্রধান দুদকের উপ-পরিচালক আবু বকর সিদ্দিক স্বাক্ষরিত চিঠিতে চাহিদাকৃত রেকর্ডপত্রের মধ্যে রয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে বছর ভিত্তিক জমাকৃত অর্থের পরিমাণ, প্রাপ্তির উৎস ও দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা ।
বিজ্ঞাপন
২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিতরণকৃত অর্থের পরিমাণ, কোন কোন প্রতিষ্ঠান (প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা) এবং কোন কোন খাতে অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। বছরভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ তথ্যসহ রেকর্ডপত্র।
এছাড়াও ওই সময়ের মধ্যে কোন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কি পরিমাণ অর্থ আদায় ও সমন্বয় হয়েছে তার বিবরণ। বিতরণকৃত অর্থের মধ্যে যা অসমন্বিত/অনাদায়ী রয়েছে তার বিবরণ। বাংলাদেশ ব্যাংক বা ইসলামী ব্যাংক কর্তৃক অডিট রিপোর্ট, পরিদর্শন প্রতিবেদন ও তদন্ত প্রতিবেদন ইত্যাদির কপি এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র যদি থাকে তার কপিগুলো জমা দিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান টিম প্রধান দুদকের উপ-পরিচালক আবু বকর সিদ্দিকের জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুসন্ধানের স্বার্থে ইসলামী ব্যাংকের রেকর্ডপত্র চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নথিপত্র হাতে পেলে অভিযোগের প্রকৃত কারণ উদঘাটিত হবে আশা করছি।
অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আবু রেজা মো. ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চাইলে তারা এখনও চিঠি পাওয়ার বিষয়ে অবগত নন বলে জানিয়েছেন।
এর আগে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে এ বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন পাঠানোর অনুরোধ করে দুদক। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার আগেই এবার ইসলামী ব্যাংকের কাছেই ওই নথিপত্র তলব করল সংস্থাটির অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে জমা হওয়া ‘অজ্ঞাত’ ২ হাজার কোটি টাকার বিষয়ে গত পাঁচ বছর আগে অনুসন্ধান শুরু করেছিল রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি। ওই সময়ে অফশোর ব্যাংকি ইউনিটের জমাকৃত অর্থের বিষয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন ও ব্যালেন্স সিট ইত্যাদি সংগ্রহ করলেও প্রকৃত রহস্য উদঘাটিত হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, ইসলামী ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে (বিশেষ ধরনের ব্যাংকিং) ২ হাজার কোটি টাকার এক অজ্ঞাত তহবিল রয়েছে। অজানা উৎস থেকে এ তহবিলের টাকা ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিংয়ে জমা হয়েছে। ওখান থেকে ওই টাকার একটি অংশ ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় স্থানান্তর করা হয়েছে। সেসব শাখা থেকে ওই টাকার একটি অংশ বিভিন্ন গ্রাহকের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনও এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছে এ প্রক্রিয়াটি এমনভাবে করা হয়েছে যাকে মানি লন্ডারিংয়ের ভাষায় ‘লেয়ারিং’ বা জটিল লেনদেনের মাধ্যমে টাকার উৎস গোপন করার মতো অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
এ বিষয়ে প্রথমবার অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করেন দুদক উপ-পরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম।
অভিযোগ সূত্রে আরো জানা যায়, ইসলামী ব্যাংকের ২০১৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনেও এ বিষয়ে এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদনের কোথাও পরিষ্কারভাবে কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। মূল ইসলামী ব্যাংক থেকে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে কোনও অর্থ বিনিয়োগ করা হয়নি। তারপরও অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে কীভাবে মূল প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা গেল-এ বিষয়ে কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি তারা।
অথচ নিয়মানুযায়ী এক স্থানে ধার হলে অন্য স্থানে সম্পদ হিসাবে থাকতে হবে। সম্পদই যদি না থাকে তাহলে ধার দেওয়া হবে কোথা থেকে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ওই ১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা কোথা থেকে এসেছে। এর বাইরে ইসলামী ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটে প্রায় ৪৩৯ কোটি টাকার অন্যান্য দায় দেখানো হয়েছে কভার ফান্ড (বিভিন্ন দায়ের বিপরীতে রাখা তহবিল) হিসেবে। ওই অর্থের সত্যতা পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চেয়েছিল। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক যে বক্তব্য দিয়েছে তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি ব্যাংকের পরিদর্শকরা। ওই তহবিলের লেনদেনের বিষয়ে আরও বিশদ তদন্তের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ থেকে ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে (এফআইইউ) অনুরোধ জানায়।
অফশোর ব্যাংকিং হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের ব্যাংকিং ইউনিট। মূল ব্যাংকের সঙ্গে এর সংযোগ থাকে শুধু লাভ-লোকসানের হিসাবের ভিত্তিতে। ব্যবস্থাপনা, হিসাব, আমানত, ঋণ এসব সম্পূর্ণ আলাদা থাকে। অফশোর ব্যাংকিংয়ের আমানত সংগ্রহ করা হয় বৈদেশিক মুদ্রায়, ঋণও দিতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। স্থানীয় মুদ্রায় কোনও কাজ হবে না।
আরএম/ওএফ