দু’দিনে বিনিয়োগকারীদের ২১ হাজার কোটি টাকা উধাও
পুঁজি হারিয়ে অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন: ছবি- সংগৃহীত
# দ্রুত পতন অস্বাভাবিক: বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান
# বিষয়টি তদন্ত হচ্ছে: বিএসইসি
সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে প্যানিক সেলের কারণে গত দু’দিনে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের ব্যাপক পতন হয়েছে। এতে সূচক নেমে এসেছে সাড়ে ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে। বাজার আরও কমতে পারে এ আশঙ্কায় অনেকে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাতে সপ্তাহের প্রথম দুই কার্যদিবসে বিনিয়োগকারীরা ২১ হাজার কোটি টাকার পুঁজি হারিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
তবে এই ধস পরিকল্পিত কি না তা খতিয়ে দেখছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কারণ জানুয়ারি মাস ইতিবাচক ধারায় পুঁজিবাজারে লেনদেন হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা দেশের পুঁজিবাজারকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করার পাশাপাশি বিদেশি এবং প্রবাসীদের আকৃষ্ট করতে যখন উদ্যোগ নিয়েছে তখনি পতন কেন? বলছে কমিশন।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বড় কয়েকটি ব্রোকার হাউজ মার্জিন ঋণের সুদ হার কমানো এবং নতুন করে ট্রেক লাইসেন্স (ডিএসইর ট্রেডিং রাইট এনটাইটেলমেন্ট সার্টিফিকেট) দেওয়াকে কেন্দ্র করে বিএসইসির ওপর তারা ক্ষিপ্ত। পাশাপাশি সম্প্রতি বিএসইসি সার্ভেলেন্সের কঠোর নজরদারি রাখায় ভিন্ন প্রক্রিয়ায় তারা কমিশনকে ঘায়েল করতে চাইছে।
বিজ্ঞাপন
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সপ্তাহের প্রথম দুই কার্যদিবস রোববার ও সোমবার ডিএসইতে ৯০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে। এ কারণে ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ২৭১ পয়েন্ট। আর তাতে রোববার বাজার মূলধন অর্থাৎ বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়েছেন ১০ হাজার ২৩৫ কোটি ৩২ লাখ ২৯ হাজার টাকা। পতন অব্যাহত থাকায় দ্বিতীয় কার্যদিবস সোমবারও ১০ হাজার ৬৭৩ কোটি ৮৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকার পুঁজি হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
বিএটিবিসি, অ্যাডভেন্ট ফার্মা, এএফসি অ্যাগ্রো, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ, ভিএফএস থ্রেডসহ ৯৩টি কোম্পানির শেয়ার ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে। যা পুঁজিবাজারের ইতিহাসে বিরল।
সিনহা সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী সুমন মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত সপ্তাহের বোরবার পুঁজিবাজারে ৬টি আইটেমে বিনিয়োগ ছিল ৫৭ লাখ টাকা। গত বৃহস্পতিবার তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫২ লাখ টাকা। আর সোমবার তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৫ লাখ টাকায়। তিনি বলেন, ভালো ভালো শেয়ার কিনেও এত লস, বলেন আমি কি করবো?
মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারদের বক্তব্য
বাজারে পরিস্থিতি নিয়ে মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রোকাররা বলছেন, শেয়ারের দাম বেশি থাকায় বিক্রি করেছি। মার্জিন ঋণ সমন্বয় করছি। এখন আমাদের শেয়ার বিক্রিতে যদি সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্যানিক হয় তা হলে কি করার আছে।
এ বিষয়ে দুবাইয়ে অবস্থানরত বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট ছায়েদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারে কিছু হলে বলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার সেল করায় দরপতন হয়েছে। এটা কেন হবে?
তিনি বলেন, এতদিন কিনেছে, এখন বিক্রি করেছে। মার্চেন্ট ব্যাংকের কাজই হচ্ছে কেনাবেচা। এতে দোষের কি?। কমিশন নির্ধারিত মার্জিন ঋণের সুদ হার কমানোয় পরিকল্পিতভাবে ধস ঘটানো হয়েছি কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মার্জিন ঋণের সুদ হার কামানোর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ কমিশনের কাছে আমরা সময় চেয়েছি এক বছর, কমিশন আমাদেরকে জুন পর্যন্ত সময় দিয়েছে।
তবে ঋণ সমন্বয়ের জন্য মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রোকাররা শেয়ার বিক্রি করছে বলে স্বীকার করেছেন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট শরীফ আনোয়ার হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কম দামে শেয়ার কিনতে হয়, তাই ব্রোকারগুলো সেল প্রেসার দিচ্ছে।
বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ভিন্ন প্রক্রিয়ায় মার্কেটে প্যানিক সেল দিয়েছে। তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভয়ে শেয়ার বিক্রি করেছে। এছাড়া ট্রেক ইস্যুও যোগ হয়েছে।
আহমেদ রশিদ লালী, ডিএসইর সাবেক সহ-সভাপতি
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের বক্তব্য
সার্বিক বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, দ্রুত এই পতন অস্বাভাবিক। পুঁজিবাজার তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই যখন দ্রুত উত্থান হয় সেটাও যেমন অস্বাভাবিক, ঠিক তেমনি কারণ ছাড়া দ্রুত পতনও বাজারের জন্য ভালো খবর না। এটা সন্দেহজনক। বিনিয়োগকারীদের উচিত যখন শেয়ারের দাম বাড়ে তখন বিক্রি করা, আর যখন শেয়ারের দাম কমে তখন কেনা।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই দরপতন স্বাভাবিক নয়। কোন কারণে হচ্ছে তাও আমার ধারণার বাইরে। কারা বাজারে দরপতনের পেছনে রয়েছে সার্ভেলেন্স দেখে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
বিএসইসির বক্তব্য
উত্থান আর পতন মিলেই পুঁজিবাজার। এই বাজারে আমাদের কিছু করার নেই। তবে যদি উত্থান পতনের পেছনে কারও যোগসাজশ থাকে। কোনো ধরনের কারসাজি হয় সেটা দেখার কমিশনের দায়িত্ব। আমরা সেই বিষয়টা দেখছি।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোবরার অস্বাভাবিক শেয়ার বিক্রির কারণে ১১টি ব্রোকারেজ হাউজকে ডেকেছি। সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। সোমবারের বড় দরপতনে সঙ্গে কোনো করসাজি রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখছি।
এমআই/জেডএস