প্রতারকচক্রের খপ্পরে পড়েছে প্রাথমিক শিশুদের উপবৃত্তির টাকা। সম্প্রতি ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’ এর মাধ্যমে ১ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থীর মায়েদের মোবাইলে উপবৃত্তির টাকা পাঠানো হয়। এরপর থেকে একটি চক্র দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিভাবকদের কাছ থেকে নগদের পিন নাম্বার, ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) জালিয়াতি করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে চলছে তোলপাড়। 

কয়েক দফায় উপবৃত্তি বিতরণে সংশোধনী এনেও প্রতারণা ঠেকাতে পারছে না প্রাথমিক উপবৃত্তি প্রকল্প ও ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অভিভাবকরা অভিযোগ করে বলছেন, নগদ অ্যাকাউন্টে উপবৃত্তির টাকা আসার ম্যাসেজ পাওয়ার পর সেই টাকা তুলতে গিয়ে দেখেন অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই। প্রতারকচক্র আগেই এ টাকা তুলে নেয়। এজন্য প্রতারকরা কখনও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং নগদের কর্মকর্তা বা এজেন্ট সেজেছে।

প্রতারণার শিকার অভিভাবকরা জানান, ফোন করে শিক্ষকের কথা বলে মেসেজে আসা নাম্বার চাইলে তারা তা দিয়ে দেন। পরে মোবাইল নিয়ে দোকানে টাকা তুলতে গিয়ে দেখেন অ্যাকাউন্টে টাকা নেই। 

যেভাবে হচ্ছে প্রতারণা

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ পৌরসভার কলাতুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সাব্বির হোসেনের মা সুফিয়া খাতুন জানান, উপবৃত্তির টাকা আসার পরপরই নগদ কোম্পানির পরিচয় দিয়ে একজন লোক ফোন করে আমি কত টাকা পেয়েছি জানতে চায়। কত টাকা এসেছে সেটা আমি বলতে পারিনি। পরে ওই ব্যক্তি আমার পিন নাম্বার জানতে চায়। পিন নাম্বার বলার পর তিন মাসের উপবৃত্তির পুরো টাকা আর অ্যাকাউন্টে পাওয়া যায়নি।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, নগদ সার্ভারে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মায়ের মোবাইল নম্বর এন্ট্রি করা হয়। সেই নাম্বারে গত বছরের এপ্রিল, মে ও জুন মাসের কিস্তির টাকা পাঠানো হয়। এ টাকা ক্যাশআউট করতে অভিভাবকরা ব্যবসায়ীদের কাছে যাচ্ছেন। এ সুযোগে কেউ কেউ টাকা আসেনি দাবি করে উপকারভোগীর টাকা তুলে নেয়। পরে অভিভাবকরা উপজেলা শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করে জানতে পারেন তার টাকা আগেই উত্তোলন করা হয়েছে।

ফেব্রুয়ারিতে নগদের মাধ্যমে প্রথম কিস্তির টাকা মোবাইলে পাঠানো হয়। এরপর থেকেই প্রতারকচক্র দেশের বিভিন্ন স্কুলের অভিভাবকদের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন দেওয়া শুরু করে। কখনও নগদের এজেন্ট, কখনও শিক্ষা কর্মকর্তা বা প্রধান শিক্ষক পরিচয় দিয়ে পিন নাম্বার, ওটিপি বা উপবৃত্তির টাকা কম গেছে বলে তাদের কাছে বিভিন্ন তথ্য চায়। আরও টাকা আপনার অ্যাকাউন্টে পাঠানো হবে বলে ওটিপি চাওয়া হয়। অনেক অভিভাবক না বুঝে সব তথ্য প্রতারকদের দিয়ে দেন। এরপর অভিভাবকদের মোবাইল অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। 

অনেক অভিভাবক টাকা আসার ম্যাসেজ পাওয়ার পর সেই টাকা তুলতে গিয়ে দোকানদারের সহায়তা নেন। টাকা আসেনি এমন কথা জানিয়ে তার পিন ও ওটিপি নাম্বার দিয়ে সেই টাকা তুলে নেয় একটি অসাধু চক্র। কোনো অভিভাবকের পিন নাম্বার প্রতারক চক্র একবার জেনে গেলে পরে যতবার ওই অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকবে সব টাকাই ঝুঁকির মধ্যে থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

সম্প্রতি বগুড়া, পাবনা, নাটোরে এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা বেশি ঘটেছে। চক্রটিকে শনাক্ত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চেয়েছেন বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও প্রকল্প কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, একটি চক্র সংঘবদ্ধভাবে এ প্রতারণা করছে।

প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রধান প্রকল্পের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. ইউসুফ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতারণার বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে জানিয়েছি। এছাড়া সবাইকে সর্তক থাকতে কিছু নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। প্রকল্প থেকে এ পর্যন্ত দুই দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যেখানেই প্রতারণার খবর পাওয়া যাবে সেখানে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে। 

প্রতারণা মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে উপবৃত্তি প্রকল্প থেকে সারাদেশের শিক্ষা কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, জিটুপি পদ্ধতিতে ২০২০ সালের এপ্রিল, মে ও জুন মাসের মাসের উপবৃত্তির টাকা পাঠানোর পর কিছু প্রতারকচক্র নগদের প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে সুবিধাভোগী অভিভাবককের কাছ থেকে মোবাইলে পাঠানো বার্তার ওটিপি ও পিন নম্বর নিয়ে সব টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কোথাও কোথাও হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও অভিভাবকদের সচেতনায় তা পারেনি।

অভিভাবকদের টাকা তোলার জন্য এজেন্টদের পিন নম্বর দেওয়া হয়। ফলে এজেন্টরাও টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ পান। এ অবস্থায় পিন ও ওটিপি নগদের প্রতিনিধি পরিচয় দেওয়া ব্যক্তির কাছে না দেন সেজন্য সব স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষকদের মাধ্যমে অভিভাবকদের অনুরোধ করতে বলেছেন প্রকল্প পরিচালক।

প্রকল্পের পরিচালক মো. ইউসুফ আলী বলেন, প্রতারক চক্র উপবৃত্তির টাকা হাতিয়ে নেওয়ার খবর জানার পরপরই আমরা নগদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে সবাইকে পিন ও ওটিপির ব্যাপারে সর্তক থাকতে বলেছি।

সহকারী শিক্ষক তপু দেবনাথ বলেন, অধিকাংশ অভিভাবক ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত নয়। ফলে প্রতারকরা এ সুযোগটাই নিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্কুলের শিক্ষকদের মাধ্যমে অভিভাবকদের সচেতনামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এছাড়াও অনলাইন, এলাকাভিত্তিক মাইকিং, সচেতনামূলক সভা ও লিফলেট বিতরণ করে অভিভাবকদের সচেতন করা যেতে পারে। 

এনএম/এসকেডি