সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী ব্র্যাক হোপ ফেস্টিভ্যাল।

বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে শুরু হয় মূল আয়োজন। ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীরা গেয়ে শোনান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। এরপর একে একে পরিবেশিত হয় শাস্ত্রীয় সংগীত এবং দেশীয় সঙ্গীত। পরিবেশিত হয় আবহমান বাংলার পুঁথি পাঠ।

বাংলাদেশের মানুষের দৃঢ়তা, সাহস ও এগিয়ে যাওয়ার গল্প উদযাপনে শুরু হয়েছে এই উৎসব। অনুষ্ঠানের শুরুতেই তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহত ও আহতদের সমবেদনা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচির পরিচালক নবনীতা চৌধুরী।

ব্র্যাক আয়োজিত তিন দিনব্যাপী : হোপ ফেস্টিভ্যাল চলবে আগামী শনিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত। ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’, ‘সম্ভাবনার শক্তি’ এবং ‘যে পৃথিবী আমরা গড়তে চাই’ এই তিনটি প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সাজানো হয়েছে তিন দিনের অনুষ্ঠানমালা।

উৎসবে দর্শকদের জন্য থাকছে আবহমান বাংলার চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতির সম্মিলন – পুঁথিপাঠ, গল্পপাঠের আসর, বায়োস্কোপ, পুতুল নাচ, শিশুদের খেলার জগৎসহ দিনব্যাপী নানা প্রদর্শনী।

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানের মূল মঞ্চে প্রতিদিনই থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। থাকছে গহনা বানানো, কারিগর ও কার্টুনিস্টদের সঙ্গে আনন্দদায়ক কর্মশালায় যোগ দেওয়ার সুযোগ। এই আয়োজনে তরুণদের দুটি পুরস্কারও প্রদান করা হবে। এর একটি ইতিবাচক সামাজিক উদ্যোগের স্বীকৃতি হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ের সেরা ৫ তরুণ সামাজিক উদ্যোক্তাকে আমরানতুন ইয়াং চেঞ্জমেকার্স অ্যাওয়ার্ড-এর মাধ্যমে সম্মাননা জানানো হবে। এছাড়াও থাকছে কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য বিশেষ সম্মাননা ‘তাগা আউটস্ট্যান্ডিং ইয়াং প্রফেশনালস অ্যাওয়ার্ড।’

জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে প্রথম দিনের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এরপর ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ-এর জীবন ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তাঁর অবদান প্রদর্শিত হয় একটি তথ্যচিত্রে। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্।

তিনি বলেন, আশা বা হোপ জিনিসটার তিনটি ভিত্তি আছে। প্রথম ভিত্তি হচ্ছে - বিশ্বাস রাখা যে, সামনে ভালো দিন আসবে। দ্বিতীয় ভিত্তি- কোন পথে গেলে ভালো দিন আসবে তা দেখতে পাওয়া। আর তৃতীয় ভিত্তি হচ্ছে নিজের উপর বিশ্বাস রাখা যে, আমি পারবো এই ভালো দিন আনতে। ব্র্যাকের অনেক কর্মযজ্ঞ এখানে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। অনেক আশা নিয়েই আমাদের এই কর্মযজ্ঞ।

তিনি আরও বলেন, মানুষ যখন অসংখ্য সমস্যার বেড়াজালে পড়ে যায় তখন আমরা কিছু উপায় বলে দেই, কিছু হাতিয়ার দেই, ঘুরে দাঁড়ানোর রাস্তা দেখাই। আর বারবার বলি - আপনি পারবেন।

উৎসবে আগত হাজারো দর্শক ও অংশগ্রহণকারীদের স্বাগত জানিয়ে স্টেডিয়ামের প্রবেশদ্বার খুলে দেওয়া হয় বেলা ১১টায়। ব্র্যাকের উন্নয়ন কার্যক্রম, সামাজিক ব্যবসা কর্মকাণ্ড, বিনিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উদ্যোগসহ দেশে-বিদেশে ব্র্যাকের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড (ইকো-সিস্টেম) নিয়ে সেজেছে উৎসব প্রাঙ্গণ।

এক কথায় বিভিন্ন স্টল, উন্মুক্ত মঞ্চ, ইমারসিভ এক্সপেরিয়েন্স সেন্টার নিয়ে পুরো আর্মি স্টেডিয়াম ছিল জমজমাট। সবার জন্য উন্মুক্ত ইনক্লুসিভ জোনসহ উৎসবে শিশুদের জন্যও রয়েছে বিশেষ কিডস্ জোন।

প্রথম দিনের আয়োজনে দর্শকরা বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের একটি রাগ পরিবেশনা উপভোগ করেন। পুঁথিপাঠ পরিবেশন করেন খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পী ফজলুর রহমান বাবু ও তাঁর দল। পাঠ করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের গল্প। স্বাধীনতার লড়াইয়ে ১৯৭১ সালের যুদ্ধক্ষেত্রে নারীদের অসামান্য অবদানকে সম্মান জানিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্রও দেখানো হয় ব্র্যাক হোপ ফেস্টিভ্যালে।

নানা সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ব্র্যাকের সহায়তায় এগিয়ে চলা আধুনিক সময়ের নারী যোদ্ধাদের গল্পও তুলে ধরা হয়েছে এই আয়োজনে। স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আফসানা আক্তারের জীবন সংগ্রাম মঞ্চে উপস্থাপন করেছে নাট্যদল ‘প্রাচ্যনাট’।

পেশাগত জীবনের এই পর্যায়ে পৌঁছাতে তিনি যে সংগ্রাম আর বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছেন, সে সব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘প্রতিদিনের যোদ্ধা’ নামের এই মঞ্চনাটকে। মঞ্চে উঠে দর্শকদের কাছে নিজের অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন ডা. আফসানা আক্তার।

অনুষ্ঠানের শেষে মনোজ্ঞ সংগীত পরিবেশন করবেন অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস ও লালন ব্যান্ড।

এদিন সব বয়সের মানুষের অংশগ্রহণে মুখর ছিল উৎসবকেন্দ্র। তারা ঘুরে ঘুরে উৎসবের সমস্ত আয়োজন উপভোগ করেছেন এবং বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন।

শিশুদের স্থাপত্যবিদ্যার ধারণা দিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ককিডস, মাসুদা খানের ড্র অ্যা ফ্রেন্ড, আড়ং এর গহনা তৈরির কর্মশালা জুয়েলস অব বেঙ্গল ছিল সবার আগ্রহের কেন্দ্রে। বিভিন্ন কারিগর, পরিবেশকর্মী, চেঞ্জমেকার এবং মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের উন্মুক্ত কর্মশালাগুলোও ছিল বেশ প্রাণবন্ত। আগে থেকেই অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে এসব কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছেন আগ্রহীরা।

এছাড়া প্লে ল্যাব, মানব পাঠাগার, পুতুল নাচ ও নানা প্রদর্শনী নজর কেড়েছে সবার। মানুষের গল্পের মধ্য দিয়ে ব্র্যাক ইকো সিস্টেমকে ফুটিয়ে তোলা স্থাপনাগুলো ছিল উৎসব কেন্দ্রের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।

ব্র্যাকের উন্নয়ন কার্যক্রম, সামাজিক ব্যবসা কর্মকাণ্ড, বিনিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উদ্যোগসহ দেশে-বিদেশে ব্র্যাকের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড (ইকো-সিস্টেম) নিয়ে সেজেছে উৎসব প্রাঙ্গণ।

ওএফএ/এমজে