বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনি ব্যবস্থায়‌ বহুদলীয় গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের। তিনি বলেন, আগামীতে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হবে। শেষ পর্যন্ত দেশে দুটি জোটের মধ্যে রাজনীতি সীমাবদ্ধ হবে। এর বাইরে অন্যরা নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে রাজনীতি করতে পারবে না।

সম্প্রতি ঢাকা পোস্টকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন জি এম কাদের। ‘সরকারের পাতানো খেলায় জাপা চাইলেই ফল পরিবর্তন করতে পারে না’ উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির আগামী দিনের পরিকল্পনা, আওয়ামী লীগ সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা এবং বড় ভাই প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্কসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক আদিত্য রিমন। আজ থাকছে এর শেষ পর্ব।

যে পদ্ধতিতে আমাদের দেশে নির্বাচন হয় তাতে বহুদলীয় গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারবে না। যতদিন যাবে রাজনৈতিক জোট তত বাড়তে থাকবে। একপর্যায়ে ছোট ছোট দলগুলো জোটবদ্ধ হবে এবং শেষ পর্যন্ত দুটি প্রধান জোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ হবে দেশের রাজনীতি

গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি

ঢাকা পোস্ট : কিছুদিন ধরে আপনিসহ জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচনে জাপা এককভাবে অংশ নেবে। যদিও আমরা এমন কথা প্রতিটি নির্বাচনের আগে প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকেও বলতে শুনেছি। জাপা কি আগামী নির্বাচনে এককভাবে অংশ নিচ্ছে?

গোলাম মোহাম্মদ কাদের : জাতীয় পার্টি ৯১, ৯৬, ২০০১ সালে এককভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সেসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট এবং বিএনপি চারদলীয় জোট নিয়ে সরকার গঠন করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বড় বিষয় আমরা বারবার তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সেটা হলো, যে পদ্ধতিতে আমাদের দেশে নির্বাচন হয় তাতে বহুদলীয় গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারবে না। যতদিন যাবে রাজনৈতিক জোট তত বাড়তে থাকবে। একপর্যায়ে ছোট ছোট দলগুলো জোটবদ্ধ হবে এবং শেষ পর্যন্ত দুটি প্রধান জোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ হবে দেশের রাজনীতি।

গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি

এটা শুধু আমাদের দেশ নয়, যেসব দেশে সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন হয়, সেখানে দলগুলো এককভাবে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের বেশি ভোট ধরে রাখতে পারে না। আমার ধারণা, বাংলাদেশে দুটি জোটই হবে না, জোট দুটি রাজনৈতিক দলে গিয়ে দাঁড়াবে। ছোট ছোট দলগুলো তাদের স্বকীয়তা নিয়ে এখানে রাজনীতি করতে পারবে না। যদি করতে হয়, তাহলে সব ধরনের মানুষ যাতে তাদের প্রতিনিধি দিতে পারে সেজন্য আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে পদ্ধতি সেটায় আমাদের যেতে হবে। যেটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ করেছে।

যদি তারা (ইসি) নির্দোষ প্রমাণিত হন, তাহলে কিছু হবে না। যদি তথ্য-উপাত্তগুলো সত্য প্রমাণিত হয় সেজন্য আইনগত যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেটা হবে

গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি

আমাদের দেশে সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু প্রধান নির্বাচনটা আমরা এখনও সেভাবে করতে পারিনি। আমাদের নির্বাচনের যে সিস্টেম, সেটা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়।

ঢাকা পোস্ট : বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরাও এ নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দিয়েছেন। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

গোলাম মোহাম্মদ কাদের : বর্তমান নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে কিছু তথ্যসহ একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে। এখন এটা যাচাই-বাছাই হবে। তারপর আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশা করি। যদি তারা (ইসি) নির্দোষ প্রমাণিত হন, তাহলে কিছু হবে না। যদি তথ্য-উপাত্তগুলো সত্য প্রমাণিত হয় সেজন্য আইনগত যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেটা হবে।

ঢাকা পোস্ট : সম্প্রতি বাংলাদেশ নিয়ে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরায় একটি তথ্যচিত্র প্রচারিত হয়। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানাবেন কী?

গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি

গোলাম মোহাম্মদ কাদের : আল-জাজিরাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন গণমাধ্যম এ ধরনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করে। বাংলাদেশ নিয়ে যে প্রতিবেদন তারা প্রচার করেছে সরকার সেটার প্রতিবাদ করেছে। পাশাপাশি প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা তথ্যও অস্বীকার করেছে। সাধারণ মানুষ আল-জাজিরার প্রতিবেদন, নাকি সরকারের প্রতিবাদ গ্রহণ করেছে; সেটা এখন দেখার বিষয়। অধিকাংশ মানুষ যেটা গ্রহণ করবে সেটাই গ্রহণীয় হবে। সেভাবেই পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাজেই এটা নিয়ে এখন আমি সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারব না।

সাধারণ মানুষ আল-জাজিরার প্রতিবেদন, নাকি সরকারের প্রতিবাদ গ্রহণ করেছে; সেটা এখন দেখার বিষয়। অধিকাংশ মানুষ যেটা গ্রহণ করবে সেটাই গ্রহণীয় হবে। সেভাবেই পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাজেই এটা নিয়ে এখন আমি সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারব না

গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি

ঢাকা পোস্ট : বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি, সরকার করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থ। বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি বিষয়গুলো কীভাবে দেখছে?

গোলাম মোহাম্মদ কাদের : আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, করোনা যতই ভয়াবহ হোক বাংলাদেশের মানুষ এর চেয়েও অনেক বেশি জটিল পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছে। তারা ছোটবেলা থেকেই জীবাণু ও ভেজালযুক্ত খাবার খাচ্ছে। হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা পাচ্ছে না, চিকিৎসকও সঠিক চিকিৎসা দিচ্ছে না। এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও যারা বেঁচে থাকছে তারা যথেষ্ট শক্তি, সামর্থ্য এবং নিজের ইমিউনিটি নিয়ে টিকে থাকছে। বাংলাদেশের মানুষ যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার শক্তি অর্জন করেছে। কাজেই করোনা বা যেকোনো দুর্যোগ বাংলাদেশে বড় কোনো ক্ষতির কারণ হবে না— এটা আমি মনে করি।

মানুষ নিজেই করোনা সামলে নেবে, ঘরে-ঘরে করোনা ডাল-ভাত হয়ে যাবে। মানুষ চিকিৎসা পাক বা না পাক, এটা থেকে বেশিরভাগ মানুষ বেঁচে যাবে। তবে করোনাসহ যেসব কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে, আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যদি চিকিৎসক ও ওষুধ নিশ্চিত করা যেত তাহলে আরও কম মানুষ মারা যেত। আমরা মনে করি, সরকার এটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন পর্যন্ত শুধু ঢাকার কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল এবং দু-একটি সরকারি হাসপাতাল ছাড়া বাংলাদেশের বেশিরভাগ হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা নেই। অক্সিজেনের অভাব প্রায় সব জায়গাতে আছে। এসব বিষয়ে সরকার ইচ্ছা করলে আরও ভালো কাজ করতে পারত। করোনা মোকাবিলায় আমরা যতটুকু সফল হয়েছি, এতে সরকারের কোনো গৌরব বা অর্জন আছে বলে আমি মনে করি না।

এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও যারা বেঁচে থাকছে তারা যথেষ্ট শক্তি, সামর্থ্য এবং নিজের ইমিউনিটি নিয়ে টিকে থাকছে। বাংলাদেশের মানুষ যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার শক্তি অর্জন করেছে। কাজেই করোনা বা যেকোনো দুর্যোগ বাংলাদেশে বড় কোনো ক্ষতির কারণ হবে না— এটা আমি মনে করি

গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি

বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসক থাকলে টেকনিশিয়ান থাকে না। অনেক স্থানে যন্ত্রপাতিও থাকে না। কোনো কোনো হাসপাতালে ওষুধ পর্যন্ত থাকে না। এসব কারণে দেশের স্বাস্থ্য খাত একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। গ্রামের গরিব মানুষ হাসপাতালে গিয়ে বেড পায় না, বারান্দায়ও জায়গা হয় না। তখন তারা পিরদের কাছে যায়। পিরদের পানি পড়া খেয়ে কেউ কেউ বেঁচেও যায়। এছাড়া তো তাদের কোনো গতি নেই। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব ছিল প্রতিটি নাগরিকের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা। এজন্য সরকারের যথেষ্ট ফান্ড আছে। লাগলে অন্য জায়গা থেকেও তারা ফান্ড নিতে পারে। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে।

গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যার যেমন ইচ্ছা, সেভাবেই লাভ করে নিচ্ছে। এছাড়া কোনো জিনিসের মান নিশ্চিত করতে পারছে না সরকার। করোনা ভ্যাকসিনের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যা হোক, বাংলাদেশের মানুষ এগুলোতে অভ্যস্ত। ভেজাল নিয়েও মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে।

ঢাকা পোস্ট : জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে যদি বলতেন…

গোলাম মোহাম্মদ কাদের : বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪০-এর কাছাকাছি। কিন্তু বাস্তবে মাঠপর্যায়ে রাজনৈতিক দল তিনটি। একটি হচ্ছে সরকারি দল। আরেকটি সরকারের প্রথম বিকল্প বিএনপি। দ্বিতীয় বিকল্প জাতীয় পার্টি। এ তিনটি দলের নেতাকর্মী আছে, নিবন্ধন আছে এবং দেশব্যাপী সংগঠন ও সমর্থক আছে।

ঢাকার কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল এবং দু-একটি সরকারি হাসপাতাল ছাড়া বাংলাদেশের বেশিরভাগ হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা নেই। অক্সিজেনের অভাব প্রায় সব জায়গাতে। এসব বিষয়ে সরকার ইচ্ছা করলে আরও ভালো কাজ করতে পারত। করোনা মোকাবিলায় আমরা যতটুকু সফল হয়েছি, এতে সরকারের কোনো গৌরব বা অর্জন আছে বলে আমি মনে করি না

গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি

যেহেতু ১৯৯১ সাল থেকে সরকার এবং তাদের প্রথম বিকল্পের বিষয়ে মানুষ সন্তুষ্ট নয়, তাই একটি বিকল্প শক্তির প্রয়োজন। জাতীয় পার্টি সেই বিকল্প শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে। আমরা এখন তৃণমূলপর্যায়েও সংগঠন তৈরি করছি। জনগণ আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে চায় না। তারা চায় এমন একটি দল যারা জনগণের দায়িত্ব নিতে পারে। সেটা দেখানোর জন্য আমরা সাধারণ মানুষকে আমাদের সভায় আসার আহ্বান জানাচ্ছি। অনেকে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন। জাপার রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন। জাতীয় এবং সাধারণ মানুষের দাবির পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি আমরা পালন করছি। প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। আমরা জনগণকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, আমরা আছি, থাকব। ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার জন্য বিকল্প একটি সরকার দিতে পারব। যে সরকারের আশায় জনগণ দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় আছে।

এএইচআর/এসকেডি/এমএআর/এমএমজে