ছয় বছর আগেও দস্যুদের হাতে মৌয়ালি, বাওয়ালি ও মৎস্যজীবীদের অপহরণ, খুনসহ নানা অপরাধ ছিল সুন্দরবনের নিত্যদিনের ঘটনা। একসময় অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলটি। তবে সুন্দরবনের সেই চিত্র পাল্টাতে থাকে ২০১৫ সালের পর থেকে।

২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য ৪৬২টি অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে। ওই দিন সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে কোনো ধরনের আতঙ্ক ছাড়া মৎস্যজীবীরা যেমন সুন্দরবনে মাছ ধরছেন তেমনি মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

কিন্তু দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও আগের সেই অন্ধকার জীবনের মামলার দায় মাথায় রয়ে গেছে অনেকের। নতুন জীবনে চলার জন্য সরকার যে অনুদান দিয়েছে তার বড় একটা অংশ চলে যাচ্ছে মামলা চালাতে

সুন্দরবনে নিজের দস্যু বাহিনী ছিল বাগেরহাটের কয়রার আল-আমিনের। আত্মসমর্পণের তিন বছর পর সেই আল-আমিনই আগের জীবনকে বলছেন কালো অধ্যায়। বলছেন, ওই জীবনে প্রচুর টাকা আসলেও সুখ মেলেনি। জীবন নিয়ে শঙ্কায় কেটেছে বড় একটি সময়। এক সেকেন্ডের নিরাপত্তা ছিল না।

তিনি বলেন, আত্মসমর্পণের পর জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে স্বস্তিতে আছি। তবে অস্বাভাবিক জীবনের অপকর্মের মামলার দায় থেকে মুক্তি মিলছে না। সরকারের অনুদানের টাকা সব যাচ্ছে মামলা চালাতে।

আল-আমিন সুন্দরবনে দস্যুতা ছেড়ে আত্মসমর্পণ করেন ২০১৮ সালে। এর আগে ভাইয়ের দলে দুই বছর কাজ করেন তিনি। এরপর নিজেই একটি আলাদা বাহিনী গঠন করেন। র‌্যাব-৬ এর সঙ্গে গোলাগুলিতে তার দলের অনেক সদস্য মারা যান। নিজেকে রক্ষা করতে শরিফ বাহিনীতে যোগ দিয়ে সেকেন্ড লিডার হলেও জীবনের নিরাপত্তা মেলেনি।

র‌্যাব আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান

তিনি বলেন, আত্মসমর্পণের সুযোগটা যে সরকার আমাদের দিয়েছে সেজন্য ধন্যবাদ। কিন্তু সরকার আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মামলা থেকে অব্যাহতি দেবে পর্যায়ক্রমে। আর্থিক সহায়তাও দিচ্ছে। স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা নিয়ে ভালো আছি।

আক্ষেপ করে আল-আমিন বলেন, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে নতুন লড়াইয়ে নেমেছি। সরকারের অনুদানের টাকায় মামলা চালাতে হচ্ছে। নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যতের চিন্তা করতে পারছি না।

দুই ছেলেকে নিয়ে দস্যু বাহিনী গড়েন জেলে আব্দুল মজিদ

আব্দুল মজিদের বাড়ি সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ থানায়। মাছ ধরতে গিয়ে বার বার জিম্মি হন জলদস্যুদের কাছে। এরপর নিজেই একটি দল গড়েন।

আব্দুল মজিদ বলেন, জেলে থাকাকালে ডাকাত দলে মাছ দেওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। এরপর ফিরে এসে নিজেই দল গড়ি। ১২-১৩ বছর কেটেছে জঙ্গল জীবন। মাতব্বররা নৌকা দিত ডাকাতির জন্য। আত্মসমর্পণ করেছি। এখনও মাছ ধরি, ঘেরে মাছ চাষ করছি। কিন্তু নিজের নামে মামলা তিনটি। ছেলে ইউনুসের নামে পাঁচ মামলা। ছোট ছেলে জাকির এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেনি। তবে সবকিছু (অস্ত্র) জমা দিয়ে পরিবারের সঙ্গেই থাকছে, মাছ ধরে।

চার বছর রাজু বাহিনীতে ছিলেন তার ছেলে ইউনুস। ইউনুস বলেন, চার বছর রাজু গ্রুপে কাজ করেছি। এরপর বাড়ি ফিরলেও ঘন ঘন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসতে থাকে বাড়িতে। আবার আত্মগোপনে চলে যাই। এরপর বাবাসহ আত্মসমর্পণ করি। সরকারের অনুদানের টাকায় জমি কিনেছি। সেখানে চিংড়ির ঘের করেছি। সংসার ভালোই চলছে। কিন্তু মামলার কারণে ভোগান্তি শেষ হচ্ছে না। মাসের একটা বড় অংশ কাটাতে হয় আদালতে। পুরো মাসজুড়ে যে আয় করি তার সিংহভাগই চলে যায় উকিলের পেছনে। মামলাগুলো থেকে রেহাই পাওয়া গেলে জীবনটা আরও সুন্দর হতো।

পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ 

মহিতোষ বীরের (৪৫) জঙ্গল জীবন শুরু হয় ১০ বছর বয়স থেকে। মাছ ধরা, মধুর চাক কাটা, গাছ কাটাকাটির কাজ করতেন তিনি। সুন্দরবন জলদস্যু মুক্ত হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেন মহিতোষ।

তিনি বলেন, জীবনে অসংখ্যবার জলদস্যুদের খপ্পরে পড়েছি। টাকা বিকাশে দিতে হতো। কখনও মারধর করে ছেড়ে দিত। কখনও মাছ ধরার নৌকা ও জাল রেখে দিত। সাগর বাহিনীর হাতেই জিম্মি হয়েছি ৩-৪ বার। এখন সুন্দরবন দস্যুমুক্ত। মাছ ধরায় আর কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

র‌্যাবের কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেন সুন্দরবনের হান্নান বাহিনীর সদস্য জলিল মুন্সি। গত ১ নভেম্বর বাগেরহাটের রামপালে দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের তৃতীয় বর্ষপূর্তি ও আত্মসমর্পণ করা ব্যক্তিদের পুনর্বাসন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনিও অংশ নেন। সেখানে তিনি বলেন, দস্যুতা ছিল অভিশপ্ত পেশা। দস্যুতা ছেড়েছি কিন্তু সমাজের অধিকাংশ মানুষ এখনও জলদস্যু হিসেবেই আমাদের চেনে।

আত্মসমর্পণের পর পুরোদমে ব্যবসায়ী হয়েছেন ইউনুস আলী। তিনি বলেন, মাছ ধরতাম। সপ্তাহে আয় হতো তিন/চার হাজার টাকা। ভালোই চলছিল সংসার। রাজনৈতিক মামলায় আসামি হয়ে বার বার জেলে যেতে হতো। মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাই। যোগ দিই দস্যু বাহিনীতে। আট বছরের দস্যুজীবনে প্রচুর টাকা এসেছে কিন্তু নিরাপদ ছিলাম না। বাড়িতে যেতে পারতাম না। পরিবারের লোকজন মরলেও খবর পেতাম না। আবার খবর পেলেও যেতে পারতাম না, মাঝে-মধ্যে সুন্দরবন ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে থাকতে হতো। আত্মসমর্পণের পর থেকে ভালো আছি। কিন্তু সন্তানের পরিচয় ও পথচলা যেন সুন্দর হয়, এ সমাজ যেন আমার ছেলেকে জলদস্যুর ছেলে হিসেবে খোটা না দেয় সেজন্য নিজেও দূরে থাকি। সন্তানকেও দূরে রেখেছি। তিন বছর আগে দস্যুতা ছাড়লেও মামলার কারণে এখনও আমাদের পরিচয় জলদস্যু।

অনুষ্ঠানে ১০২টি ঘর হস্তান্তর করা হয়

গত ১ নভেম্বর দুপুরে বাগেরহাটের রামপালে দস্যুমুক্ত সুন্দরবন দিবসের তৃতীয় বর্ষপূর্তি ও আত্মসমর্পণকৃতদের পুনর্বাসন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে র‌্যাব। অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণকারী জলদস্যুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১০২টি ঘর, জিনিসপত্রসহ মুদি দোকান ৯০টি, জাল ও মাছ ধরার নৌকা ১২টি, ইঞ্জিনচালিত নৌকা, বাছুরসহ গবাদি পশু ২২৮টি হস্তান্তর করা হয়।

ওই অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ভুলেও কেউ পুনরায় দস্যুতায় ফিরবেন না। যারা দুষ্কর্মের এ চিন্তা করছেন, তারা তা ভুলে যান। যদি কেউ আবারও বিপথে যান, তাহলে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী বসে থাকবে না। বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, কোস্ট গার্ড এখন খুবই চৌকস। যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তারা এখন সক্ষম।

তিনি বলেন, আত্মসমর্পণকারীদের দাবি ছিল মামলা প্রত্যাহারের। ধর্ষণ ও খুনের মামলা ছাড়া অবশ্যই পর্যায়ক্রমে মামলা তুলে নেওয়া হবে। সরকারি অনুদান যাতে উকিলের পেছনে ঢালতে না হয় সেটা আমরা দেখব।

র‌্যাবের পক্ষ থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা হস্তান্তর করা হয়

পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ বলেন, যারা খুন ও ধর্ষণ করেছে তাদের বিষয়ে কোনো আইনগত সহযোগিতা সরকার করবে না। কারণ এ দুটি খুবই জঘন্য ও গর্হিত অপরাধ। কারণ যদি কারও আত্মীয়-স্বজন খুন হয়ে থাকে তাহলে সেই খুনের বিচার তাদের পাওয়ার অধিকার রয়েছে। জলদস্যুদের এ দুটি অপরাধ ছাড়া বাকি সব ধরনের অপরাধের বিষয়ে নমনীয় হব।

র‌্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, এখন পর্যন্ত ৩২টি বাহিনীর ৩১৮ জন দস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন। প্রত্যেকে আমাদের নজরদারির মধ্যে রয়েছেন। যারা র‌্যাবের সঙ্গে থাকবেন, তাদের সঙ্গে র‌্যাব থাকবে। যারা আত্মসমর্পণের পর আবার সেই অন্ধকার জীবনে যাবেন তাদের আর অনুদান-সহায়তা করা হবে না।

জেইউ/এসকেডি