সুন্দরবনে এখন শান্তির সুবাতাস বইছে। জলদস্যুমুক্ত সুন্দরবনে আবারও বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণ করে যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে তাদের বিপথে নেওয়ার চেষ্টা যারা করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে র‍্যাব।

র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) মহাপরিচালক (ডিজি) ও অতিরিক্ত আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের সতর্কবার্তা জারি ছিল। এখনও তা জারি রয়েছে বলেই সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটক বাড়ছে, মানুষের গমনাগমন বেড়েছে, জলদস্যুতা শূন্যের কোঠায় নেমেছে। বাঘ ও হরিণের সংখ্যাও বেড়েছে। আত্মসমর্পণকারী জলদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে চলার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।

সোমবার (১ নভেম্বর) দস্যুমুক্ত সুন্দরবন দিবসের তৃতীয় বর্ষপূর্তি। এ উপলক্ষে বাগেরহাটের রামপালে আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের পুনর্বাসনে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে র‍্যাব। শনিবার (৩০ অক্টোবর) বিকেলে র‍্যাব সদর দফতরে সাংবাদিকদের এ কথা জানান র‍্যাব ডিজি।

তিনি বলেন, সুন্দরবন উপকূলে আশির দশকে মানুষ যেতে পারত না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে একটি টাস্কফোর্স গঠনের পর সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর থেকে জলদস্যুরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তারা ফেরারি জীবন শুরু করে। পরে র‍্যাবের হাতে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া শুরু করে। পালিয়ে থাকা জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে থাকে। তাদের মধ্যে বোধোদয় হয় যে জলদস্যুতা কোনো সম্মানজনক পেশা নয়। এরচেয়ে স্বল্প আয়েও সম্মান ও গর্বের সঙ্গে ভালো থাকা যায়।

র‍্যাবপ্রধান আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, র‍্যাব ২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত সুন্দরবনে জলদস্যুমুক্ত অভিযান শুরু করে। এ সময়ে ৪২৬টি অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলা-বারুদসহ ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ সদস্য র‍্যাবের হাতে আত্মসমর্পণ করে। সম্পূর্ণরূপে জলদস্যুমুক্ত হওয়ার পর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করে। গত তিন বছর ধরে সেই সাফল্য র‍্যাব ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরপর থেকে বিভিন্ন ঈদে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও করোনার সময় মানবিক সাহায্য-সহায়তা দেওয়া হয়েছে। দস্যিপনা ছেড়ে যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন তাদের প্রত্যেককে এক লাখ করে টাকা দিয়েছে সরকার। র‍্যাবও বিভিন্ন সময় মানবিক, আর্থিক ও সামাজিক সহায়তা দিয়েছে।

সম্প্রতি র‍্যাবের পক্ষ থেকে এক সমীক্ষা চালানো হয়। যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং চাহিদা জানতে চাওয়া হয়। তাদের মধ্যে কেউ দোকান, কেউ নৌকা, কেউ জাল চেয়েছেন মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের জন্য। তাদের প্রয়োজনীয়তা জেনে র‍্যাব সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

র‍্যাবের ডিজি বলেন, এখন সুন্দরবনে শান্তির সুবাস বইছে। অপহরণ, হত্যা আর সুন্দরবনে দেখা যায় না। জেলেদের কষ্টার্জিত উপার্জনের ভাগও কাউকে দিতে হচ্ছে না। বন্যপ্রাণীসহ সুন্দরবনের মাওয়ালি, বাওয়ালি, বনজীবী, সবাই নির্বিঘ্নে জীবনযাপন করছে। এখন পর্যটক, দর্শনার্থী, জাহাজের নাবিকরা সুন্দরবনে নির্ভয়ে যেতে পারছে।

র‍্যাব জলদস্যুমুক্ত সুন্দরবন গড়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রতিনিধি, বন বিভাগ, স্থানীয় বাসিন্দা, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানান র‍্যাবের ডিজি। বলেন, একটা জিনিস অর্জন করার চেয়ে ধরে রাখা অনেক বেশি কঠিন। জলদস্যুমুক্ত সুন্দরবন ধরে রাখার জন্য দুবলার চর ও মুন্সিগঞ্জে আমরা দুটি ক্যাম্প স্থাপন করেছি। নিয়মিত ফুট-প্যাট্রল, নৌ-প্যাট্রল করছি। প্রয়োজনে হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছি। গোয়েন্দা নজরদারি রাখছি। যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদেরও আমরা মনিটরিং করছি।

তিনি বলেন, আত্মসমর্পণ করেও যারা আমাদের সঙ্গে থাকবে না, তাদের সহায়তা দেওয়া হবে না। সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। সম্পর্ক যাতে ভালো থাকে, আত্মসমর্পণকারীরা যাতে ভালো থাকে, তাদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে গণসংযোগ হচ্ছে। যারা ভালো পথে ফিরেছে তাদের ভালো পথেই রাখতে চাই। যারা এখনও আসেনি তাদের নাম আমরা প্রকাশ করতে চাই না। আমরা উৎসাহিত করতে চাই তারা যেন নেতিবাচক পথ থেকে ফিরে আসে।

‘আত্মসমর্পণকারী অনেকেই আমাদের বলেছে, তাদের সন্তান স্কুলে গেলে বাবার পরিচয় দিতে পারত না। তারা আজ বুক ফুলিয়ে বলতে পারছে বাবা কী করে। লজ্জিত হবার মতো আর কিছু নেই। বরং তারা গর্বিত কণ্ঠে বলতে পারে যে আমার বাবা দোকানদার, মাঝি কিংবা জেলে।’

এবার আত্মসমর্পণকারীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১০২টি ঘর, জিনিসপত্রসহ মুদি দোকান ৯০টি, জাল ও মাছ ধরা নৌকা ১২টি, ইঞ্জিনচালিত নৌকা আটটি, বাছুরসহ ২২৮টি গবাদি পশু দেওয়ার ঘোষণা দেন র‌্যাবের ডিজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। বলেন, ‘যদি অসুখ-বিসুখে গরু মারাও যায় সেজন্যও থাকবে বরাদ্দ। আমরা চাই জলদস্যুরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরুক।’

র‌্যাবের নৌ উইং-কে শক্তিশালী করার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না— জানতে চাইলে র‍্যাবপ্রধান বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপত্তার জন্য র‍্যাবের নৌ উইং-কে শক্তিশালী করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রতি বছরই কিছু না কিছু সংযুক্ত হচ্ছে র‍্যাবের নৌ উইংয়ে। আমরা বেশকিছু নৌযান সংগ্রহ করেছি। আরও করা হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়ায়। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকায় নৌ-চলাচলের সক্ষমতা র‍্যাবের আছে।

সুন্দরবনের আত্মসমর্পণকারী জলদস্যুদের পড়াশোনা ও শিক্ষার বিষয়ে র‍্যাবের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নাইট স্কুলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যারা ভালো পথে এসেছে তাদের জন্য গুচ্ছ আকারে পড়াশোনার উদ্যোগ কীভাবে শুরু করা যায় সেটা নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তাদের সন্তানরা যেন নিয়মিত স্কুলে যায় সেজন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

সুন্দরবনের পরিবেশ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় র‍্যাবের সদস্যরা কী ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুন্দরবনকেন্দ্রিক আগের মতো আর কোনো ঘটনা ঘটছে না। আসলে কিছুই যে ঘটে না তা নয়। তবে তা হিসাবে খুবই নগণ্য। ওই এলাকায় কাজ করা খুবই কঠিন। আমাদের সদস্যরা অপেক্ষা করে কখন বৃষ্টি আসবে, মিঠা পানি সংগ্রহ করবে। কারণ, সেখানে নোনা পানি। র‍্যাব সদস্যরা সেখানকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অনেক কষ্ট করেছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক পরিবেশ অনুকূলে রয়েছে। আমরা প্রায়ই বন বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে অভিযানে যাই। আমাদের সেখানে পরিবেশগত প্রশিক্ষণ না থাকলেও বন বিভাগের আছে।

সুন্দরবন ছাড়াও অন্যান্য নদী ও সমুদ্র উপকূলে জলদস্যুতার খবর মেলে। সেসব এলাকায় র‍্যাব কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবে কি না— জানতে চাইলে র‍্যাবের মহাপরিচালক বলেন, কোনো অপরাধীকে শুধু অভিযান কিংবা প্যাট্রলিং দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। আমরা গ্রেফতার করি, আইনের আওতায় নিয়ে আসি। কোনো এলাকায় কিছু ঘটলে সেখানে র‍্যাব উপস্থিত হয়, কাজ করে। আমাদের সংশ্লিষ্ট এলাকায় ক্যাম্প আছে। গোয়েন্দা কার্যক্রমও চলমান।

জেইউ/এইচকে/এসকেডি