বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন নাঈম হোসেন (২৭)। গত বুধবার (৮ ডিসেম্বর) রাত ১টার দিকে বন্ধুর মোটরসাইকেলে দক্ষিণখান পশ্চিম মোল্লারটেকের বাসায় ফিরছিলেন। বিজয় সরণি মোড়ে পৌঁছতেই বেপরোয়া গতির একটি ট্রাক তাদের চাপা দেয়। বন্ধু গুরুতর আহত হলেও প্রাণ যায় নাঈমের।

গত ৩ ডিসেম্বর রাতে ছোট বোনকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করে ডেমরার শারুলিয়ার বাসায় ফিরছিলেন দৈনিক সংবাদ পত্রিকার প্রুফ রিডার এমদাদ হোসেন (৬০)। মোহাম্মদপুরের মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারের সামনে দ্রুতগতির একটি ট্রাক তাকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি তাজা প্রাণ ঝরে যায় সড়কে। শুধু তা-ই নয়, গত তিন সপ্তাহে রাজধানীর সড়কে ঝরে চার শিক্ষার্থীর প্রাণ। ফলে নতুন করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, গত নভেম্বর মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৭৯টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪১৩ জন। আহত ৫৩২ জন। এর মধ্যে ১৫৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৮৪ জন। যা মোট মৃত্যুর ৪৪.৫৫ শতাংশ।

এ সময়ে সাতটি নৌ-দুর্ঘটনায় নয়জন নিহত, নিখোঁজ হন পাঁচজন। ১১টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত এবং দুজন আহত হন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্ট পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ট্রাফিক পুলিশ ছয় লাখ ৩৩ হাজার ৫৬২টি মামলায় জরিমানা করেছে ১৫২ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৮৭ টাকা। ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত তিন বছরে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন এবং যান চলাচলে শৃঙ্খলার কাজে বাধা দেওয়ায় রাজধানীতে ২০ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৫টি যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ২০১৯ সালে ১৭ লাখ ৩০ হাজার ৭৫৭টি, ২০২০ সালে এক লাখ ৩৮ হাজার ৯৭৪টি এবং ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মামলা হয়েছে এক লাখ ৯৭ হাজার ৪৫৪টি যানবাহনের বিরুদ্ধে।

গত তিন বছরে জরিমানা করা হয়েছে ১৫৮ কোটি ৪৮ লাখ ছয় হাজার ৮০৯ টাকা। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ৮২ কোটি ৩৭ লাখ ১১ হাজার ৮০৮ টাকা, ২০২০ সালে ৩০ কোটি ৬৪ লাখ ৪৯ হাজার ৬০০ টাকা এবং চলতি বছরের (২০২১ সাল) সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জরিমানা করা হয়েছে ৪৫ কোটি ৪৬ লাখ ৪৫ হাজার ৪০১ টাকা।

পুলিশ সদরদফতরের ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট শাখা থেকে পাওয়া নথিতে দেখা যায়, গত আগস্ট মাসে সারা দেশে ৮০ হাজার ১৩৭টি গাড়ির বিরুদ্ধে করা মামলায় জরিমানা হয়েছে ২৫ কোটি ৪১ লাখ ৩০ হাজার ৭৪৫ টাকা। আট মাসে সারা দেশে ছয় লাখ ৩৩ হাজার ৫৬২টি মামলা হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে ১৫২ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৮৭ টাকা। এর মধ্যে আদায় হয়েছে ১৩১ কোটি ৩৮ লাখ ৯৫ হাজার ৪৭৯ টাকা।

ট্রাফিক শৃঙ্খলার উদ্দেশ্যে পুলিশের তৎপরতা ও মামলার সংখ্যা বাড়লেও রাজধানীতে বাড়েনি সড়কের সংখ্যা। উল্টো তা কমেছে। কোথাও কোথাও মেট্রোরেল ও বিআরটি’র মতো উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে সংকুচিত হয়েছে প্রশস্ত সড়ক।

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে প্রতি দুই বছর অন্তর ফিটনেস নবায়নের নিয়ম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সাত লাখ ছয় হাজার ৪১৩টি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাত লাখ ৫০ হাজার ৭২২টি যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট ইস্যু ও নবায়ন করে বিআরটিএ। বাকি যানবাহনের ফিটনেস নবায়ন হয়নি। যা রাজধানীতে অবৈধভাবে চলছে।

চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশে রেজিস্ট্রেশন হওয়া মোটরযানের সংখ্যা ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৪৪ টি। এর মধ্যে ঢাকায় চলাচল করে ১৬ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯৬টি। মোট ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে ৩৭ লাখ ৬৩ হাজার ১৭৪ মোটরযানচালকের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিসাবের বাইরে শুধু রাজধানীতেই চলে ২৭ লাখের মতো যানবাহন।

যদিও রাজধানীতে বাড়েনি সড়ক, উল্টো উন্নয়ন ও সেবার নামে বছরজুড়ে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। ফলে মূল সড়কও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এছাড়া অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল, সড়কে বাড়ছে যানজট।

ডিএমপি’র ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি আধুনিক শহরের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ জায়গা রাখতে হয় সড়ক ব্যবস্থার জন্য। কিন্তু আমাদের রয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ। সম্প্রতি সেটা আরও কমেছে মেট্রোরেল ও বিআরটি’র  উন্নয়ন কাজের কারণে। ফলে গতি কমেছে সড়কে, বেড়েছে যানজট। অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে চালক-যাত্রী উভয়ের মধ্যে। দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে।

এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদ্যমান সড়কের ২৫ শতাংশের বেশি রয়েছে অবৈধ দখলে। কোথাও পার্কিং, কোথাও হকারদের দখলদারি, কোথাও অবৈধ স্থাপনা কিংবা নির্মাণাধীন ভবনের দখলদারি; কোথাও আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানের অঘোষিত পার্কিং। এছাড়া হকারদের দখলে রয়েছে অধিকাংশ ফুটপাত। পথচারীদের হাঁটতে হচ্ছে প্রধান সড়কে। যে কারণে যানজট আর জনজটে বাড়ছে দুর্ঘটনা। ট্রাফিক পুলিশ কিংবা সিটি করপোরেশনের সদিচ্ছা থাকলেও অন্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নেই কোনো সমন্বয়। যে কারণে দুর্ঘটনা কমছে না, দখলদারিও কমছে না।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব সাইদুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনার ৪১ শতাংশই ঘটছে জাতীয় মহাসড়কে। ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও পিকআপের মাধ্যমে দুর্ঘটনা হচ্ছে ২১.৪২ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাসে ১১.৫৩ শতাংশ আর মোটরসাইকেলে ৩০.৫৮ শতাংশ। খুবই দুঃখজনক হলেও মোট দুর্ঘটনার ২৬.৫৭ শতাংশই ঘটছে রাজধানী ঢাকায়।

সংগঠনের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা এবং শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহনের চলাচল, তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালান, জনসাধারণের ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি।

১৫ ভাগ যাত্রীর দখলে ৭০ ভাগ সড়ক

স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান বা এসটিপি’র হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় কম-বেশি ১৫ ভাগ যাত্রী ব্যক্তিগত গাড়িতে যাতায়াত করেন। এসব গাড়ির দখলে থাকে ৭০ ভাগেরও বেশি সড়ক। বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী গণপরিবহন ব্যবহার করেন। অর্থাৎ তারা সড়কের মাত্র ৩০ ভাগ এলাকা ব্যবহারের সুযোগ পান।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজধানীতে সড়কের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু মানুষ বেড়েছে, বেড়েছে যানবাহনের সংখ্যা। আপনি চাইলেও ঢাকার যানজট কমাতে পারবেন না। স্বাভাবিক ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি গাড়ি চলছে। প্রতিযোগিতার কারণে দুর্ঘটনা যেমন ঘটছে, আইনের ব্যত্যয়ও হচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশ মানুষকে সাবধান ও সতর্কতার পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধিতেও কাজ করছে। বারবার একই ঘটনায় জড়ালে মামলা দেওয়া হচ্ছে।

তবে মেট্রোরেল, বিআরটি’র কাজ শেষ হলে রাজধানীতে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। মানুষ বিকল্প যোগাযোগের ব্যবস্থা পাবে। মেট্রোরেল চালু হলে একসঙ্গে ৬০ হাজার মানুষ চলাচলের সুযোগ পাবে। তখন সড়কের ওপর চাপ কমবে। যানজটও কমবে, দুর্ঘটনার ঝুঁকিও কমে আসবে।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মো. সেলিম রেজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকার মিরপুর, বনশ্রী, তেজগাঁও, মোহাম্মপুর, আদাবর, উত্তরা ও গুলশানের চিত্র বদলে গেছে। অনেক সড়ক ও ফুটপাত আমরা দখলমুক্ত করেছি। শুরু হওয়া উন্নয়নকাজ যথাসময়ের মধ্যে শেষ এবং কাটা রাস্তা স্বাভাবিক করতে তাগিদ দিচ্ছি।

উন্নয়নের প্রসব বেদনার ভোগান্তি আরও কিছুদিন হয়তো থাকবে। তবে মেট্রোরেল ও বিআরটি’র কাজ শেষ হলে যাতায়াত ও যানজটের সমস্যা আশা করছি আর থাকবে না— বলেন ওই কর্মকর্তা।

জেইউ/এমএআর/