আজ ২ এপ্রিল। পৃথিবীজুড়ে দিনটি পালিত হয় অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে। করোনা মহামারিকালে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির কর্মক্ষেত্র ও নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মহামারিত্তোর বিশ্বে ঝুঁকি প্রশমন, কর্মক্ষেত্রে সুযোগ হবে প্রসারণ’।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্যও নতুন একটা সংকট। কেননা অটিজম শিশুদের এখন ঘরেই থাকতে হচ্ছে। এ অবস্থায় কোথাও বের হওয়া সম্ভব নয়। তাদের স্কুলেও যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় শিশুদের নানা বিষয়ে শেখানোর পাশাপাশি মানসিক বিকাশে অভিভাবকদের ভূমিকা রাখতে হবে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের সবশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশে অটিস্টিক তথা প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা আনুমানিক দেড় লাখ। বাংলাদেশে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী।

সূত্রমতে, ২০১৩-২০১৬ সালে দেশে অটিজম শিশুর সংখ্যা ছিল ৪১ হাজার ৩২৯ (সূত্র- প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ, সমাজসেবা অধিদফতর ওয়েবসাইট)। চলতি বছরে তা আরও বেড়েছে। এদিকে বেশ কিছুদিন আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে প্রতিবন্ধী শিশুর হার তিন শতাংশ আর ঢাকার বাইরে দশমিক সাত শতাংশ।

অটিজম কী?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে অটিজম কোনো রোগ নয়। এটি একটি শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা। শিশুর জন্মের প্রথম দুই-তিন বছরের মধ্যেই এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। অটিজম এমন একটি বিকাশজনিত সমস্যা, যা হলে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্য মানুষ বা বিষয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ থাকে না। এছাড়া সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, ভাষা, আবেগেয় বিষয়গুলোও পরিলক্ষিত হয় না।

এর মানে এই নয় যে, অটিস্টিক শিশু বোকা কিংবা মেধাবী নয়। বেশিরভাগ অটিস্টিক শিশু অত্যন্ত সম্ভাবনাময়ী হয়। প্রতি ১০ জন অটিস্টিক শিশুর মধ্যে একজনের ছবি আঁকায়, গানে, গণিতে বা কম্পিউটারে খুবই দক্ষতা থাকে। অটিস্টিক শিশুকে ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলে পরবর্তী সময়ে সে অনেক গুণী কেউ একজন হয়ে উঠতে পারে। এখন তারাও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, কোনো শিশুর অটিজম নির্ণয় হলে অতিদ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। পাশাপাশি পরিবারের সবার সচেতনতাও বৃদ্ধি করতে হবে। শিশুটির সঙ্গে কথা বলার মাঝে, পড়ানোর সময়, সামাজিক বন্ধনে, খেলাধুলার মাঝেও বিভিন্ন বিষয় শেখাতে হবে। হাসি-খুশিতে রাখতে হবে সবসময়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী, মায়ের গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চিকিৎসা ও ওষুধ সেবন না করা হলে কিংবা প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার না খেলে গর্ভের শিশুদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ না হলে শিশু অটিস্টিক হিসেবে জন্ম হতে পারে।

এই প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউসিজি) অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, অটিজম কোনো রোগব্যাধি নয়। এটি জন্মগত স্নায়বিক দুর্বলতা। শিশুর জন্মের ২-৩ বছর বয়সের মধ্যে এটির প্রকাশ ঘটে। হাঁটা-চলা, আচার-আচরণে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়।

তিনি বলেন, আগে অনেকে অটিজম আক্রান্ত শিশুর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে পাগল বলে মনে করতেন। কিন্তু এখন চিকিৎসক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল। তাই অটিজম আক্রান্ত শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়।

অটিজম শিশুদের উন্নয়নে বাংলাদেশে অগ্রদূত পুতুল

অটিজম শিশুদের কল্যাণে সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ অধিদফতর বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। অটিজম শিশুদের উন্নয়নে বাংলাদেশে অগ্রদূত হিসেবে কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষাগ্রহণ করেছেন তিনি। উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে অটিজম বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে তিনি কাজ করে চলেছেন।

অটিজম ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজ-অর্ডার সম্পর্কিত জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ বিশ্বজুড়ে তার কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ২০১৯ সালে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের ১০০ জনের তালিকায় স্থান করে নেন। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানসিক স্বাস্থ্যসম্পর্কিত ২৫ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সায়মা ওয়াজেদ।

তার উদ্যোগেই ২০১১ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় অটিজম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের পর গড়ে ওঠে সাউথ এশিয়ান অটিজম নেটওয়ার্ক। সংগঠনটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অটিস্টিক শিশুদের স্বাস্থ্য, সামাজিক ও শিক্ষা সহায়তা দেওয়ার জন্য অবকাঠামো গড়তে কাজ করে চলেছে।

তার উদ্যোগেই অটিজম সচেতনতায় বাংলাদেশের একটি প্রস্তাব বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পরিষদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।

করোনায় সচেতনতামূলক সব কর্মসূচি বাতিল

প্রতি বছর দিবসটিতে রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। তবে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে জনসমাগম হয় এমন সব অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে।

অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে শুক্রবার দৈনিক পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে। অটিজম বৈশিষ্ট‌্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের সম্মানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন দফতর-সংস্থা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নীল বাতি জ্বালানো হবে। এছাড়া অটিজম বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে রোড ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে। বিশেষ স্মরণিকা ও লিফলেট ছাপানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে অটিজম বৈশিষ্ট‌্যসম্পন্ন দুই হাজার ৫০০ ব্যক্তিকে চিকিৎসা অনুদান বাবদ ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।

টিআই/এফআর