‘ভ্যাকসিনই যথেষ্ট নয়, মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধিও’
আলোচনায় অংশ নিয়েছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারির গতিপ্রবাহ লক্ষ্য না করে শুধু ভ্যাকসিনের দিকে তাকিয়ে থাকা হবে মারাত্মক ভুল। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার মেয়াদ নিশ্চিত নয়। বাংলাদেশে কবে সবাই ভ্যাকসিন পাবে তাও নিশ্চিত নয়। তাই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
রোববার (০৩ জানুয়ারি) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘ভ্যাকসিন এবং অন্যান্য প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে বক্তারা এ মতামত ব্যক্ত করেন।
বিজ্ঞাপন
তারা দাবি করেন, বাংলাদেশে পরীক্ষা কম হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে সংক্রমণ কম। বয়স্ক জনসংখ্যা কম বলে মৃত্যুহারও কম। তাই বাংলাদেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল বলে অনেকে ভ্রান্তিবিলাসে রয়েছেন। এতে সাধারণ জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। তারা ভাবছেন যেহেতু দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল সুতরাং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রয়োজন নেই। প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত না হলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, করোনা বাংলাদেশের একটি ‘স্থায়ী এন্ডেমিক ডিজিজ’-এ রূপ নিতে যাচ্ছে। বেসরকারিখাতে ভ্যাকসিন ছেড়ে দিলে মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। মধ্যস্বত্বভোগীরা ফায়দা লুটবে।
ওয়েবিনারে আলোচনায় অংশ নেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) সাবেক অধ্যাপক ড. বেনজির আহমেদ, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া রাজ্যের ফুলটন কাউন্টির চিফ এপিডেমিওলোজিস্ট ড. ফজলে খান এবং ব্র্যাক এইচএনপিপি’র সহযোগী পরিচালক ড. মোর্শেদা চৌধুরী। কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিশ্ব ব্যাংকের সিনিয়র হেলথ স্পেশালিস্ট এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার।
বিজ্ঞাপন
অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে ধন্যবাদ জানান ড. ফজলে খান। যুক্তরাষ্ট্রে নিজের ফুলটন কাউন্টির পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বোঝান, কিভাবে একজন দুজন থেকে শুরু করে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, করোনা মহামারির গতিপ্রবাহ লক্ষ্য না করে শুধু ভ্যাকসিনের দিকে তাকিয়ে থাকা হবে মারাত্মক এক ভুল। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে যারা করোনা রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সেসব চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ফ্রন্টলাইনার হিসেবে ভ্যাকসিনের অগ্রাধিকার পাবেন। এরপর অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা থাকবেন।
ড. ফজলে খান বলেন, ভ্যাকসিনের আশায় বসে থাকলে চলবে না। তাছাড়া ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার মেয়াদও কেউ বলতে পারছেন না। কোনো এলাকার ৮০-৮৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত ‘হার্ড ইমিউনিটি’ পাওয়াও সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মতো দেশে কবে সবাই ভ্যাকসিন পাবে তাও নিশ্চিত নয়। তাই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে৷ মাস্ক পরার অভ্যাস করতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। হাত ধুতে হবে। সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সেই সঙ্গে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হবে। কেইস ইনভেস্টিগেশন, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং নিয়মিত করতে হবে।
ড. বেনজির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে ট্রেসিং, টেস্টিং, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন এসব ক্ষেত্রে শুরু থেকেই ঘাটতি ছিল। বাংলাদেশে মৃত্যুহার কম। আশি বছরের বেশি বয়স্ক জনসংখ্যাও কম। তাই কিছু সুবিধা ছিল। কিন্তু করোনাকে সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি উপরের ঘাটতিগুলোর জন্য। সংক্রমণ কমানোর দিকে নজর দিলে করোনাকে অনেকটাই রোখা যেতো। করোনাকালে জনস্বাস্থ্য সে অর্থে কোনো গুরুত্বই পায়নি। মহামারিতে খুঁজে খুঁজে সংক্রমিত ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে হয়৷
তিনি বলেন, করোনার সময়ে নেতৃত্বের সংকট ছিল সুস্পষ্ট। শুরু থেকেই আইইডিসিআর করোনাকে গুরুত্ব দেয়নি। সমস্যার শুরুটাও সেখান থেকেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও ওতপ্রোতভাবে লেগে থেকে কাজ করেননি। সে কারণে অধিদপ্তর পর্যায় থেকেই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে, যদিও তাদের পক্ষে সব করা সম্ভব নয়।
ড. বেনজিরের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে ড. মোর্শেদা বলেন, বেশিরভাগ মানুষ এখন মনে করেন দেশে আর করোনা নেই। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী মনে করেন, এটা গ্রামের রোগ নয়, গরিবের রোগ নয়। এগুলো শুধু জনসাধারণের মধ্যেই নয়, এই ভ্রান্ত ধারণাগুলো কর্তৃপক্ষের মধ্যেও রয়েছে, যা দূর করার পরিকল্পনা করতে পারেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া যারা ভাবছেন করোনা হবে না, তারা ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যাপারেও উদাসীন হতে পারেন। আগে সরকার এবং এনজিও একসঙ্গে কাজ করে বিভিন্ন টিকাদান কর্মসূচিতে সফলতা পেয়েছিল। এখনও সেভাবে কাজ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টেনে ড. ফজলে খান বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সচেতন না হলে যে কি ভয়ানক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে তা যুক্তরাষ্ট্রের মতো পৃথিবীর শীর্ষ উন্নত দেশের করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার দেখেই বোঝা যায়। ভ্যাকসিন আর ভ্যাকসিনেশন এক জিনিস নয়। আর ভ্যাকসিনেশন সহজ কোনো প্রক্রিয়াও নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও এক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছে৷
বেসরকারিখাতে ভ্যাকসিন দেওয়ার বিরোধিতা করে তিনি বলেন, শুরু থেকেই বলছি এটা সরকারিভাবে বিনামূল্যে দেওয়া উচিত।
আগে পরীক্ষার ক্ষেত্রে সরকারিভাবে কম, বেসরকারিভাবে বেশি অর্থব্যয় করতে হয়েছে, দুর্নীতিও হয়েছে, এখন সরকার কি সবাইকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেবে সঞ্চালক ড. জিয়ার এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার এক্ষেত্রে এক ধরনের দ্বিধায় রয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছিল, সবাইকে বিনামূল্যে দেওয়া হবে৷ পরে বলা হলো, যাদের টাকা আছে তারা কিনবে। এখন বেসরকারিখাতে ভ্যাকসিন আনা হলে তা কিভাবে বিতরণ করা হবে তা নিয়েও ভাবা হচ্ছে৷ পরীক্ষার ক্ষেত্রে চার্জ আরোপ করা যে কতোটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল তা এখন বুঝতে পারছে৷ বেসরকারি হাসপাতালে করোনা নিয়ে ভর্তি হয়ে অতিরিক্ত অর্থব্যয় করে রোগী নিজেও মরছেন, পরিবারও নিঃস্ব হচ্ছে৷
তিনি বলেন, বেসরকারিখাতে ভ্যাকসিন ছেড়ে দিলে এর মূল উদ্দেশ্য কাকে ভ্যাকসিন আগে দেওয়া হবে, সেটাই ব্যাহত হবে। তাছাড়া অনেককে অতিরিক্ত অর্থব্যয় করতে হবে, তেমনি ভুয়া ভ্যাকসিন বিক্রির সম্ভাবনাও থাকবে। সরকারি ভ্যাকসিন বাইরে বিক্রি হওয়ার ঝুঁকিও থাকবে।
নিজের ভ্যাকসিন কেনার অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে তিনি প্রশ্ন রাখেন, তখন কোনো মধ্যস্বত্ত্বভোগী কোম্পানির প্রয়োজন না হলে এখন কেন সরকারের অংশীদার একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির প্রয়োজন হবে? এই করোনাকালেও তারা নিজেদের ব্যবসা করার কথা মাথায় রাখছে।
করোনাকালে সরকার চলতি বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ স্বাস্থ্যবিভাগের জন্য রাখলেও সেটা খরচ করা হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রণোদনার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র একজন তা পেয়েছেন।
সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে সঞ্চালক ড. জিয়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নের ফোরাম আয়োজিত অনুষ্ঠান সমাপ্ত ঘোষণা করেন।
টিআই/জেডএস