পশ্চিমবঙ্গে দেবী দূর্গাকে কটাক্ষ করে বিপাকে বিজেপি সভাপতি
সনাতন ধর্মের দেবী দুর্গাকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষের এক মন্তব্যে সমালোচনার মুখে পড়েছে দলটি। রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস এ বিষয়ে বলেছে- দিলীপ ঘোষ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের ধর্মানুভূতিতে ‘সরাসরি আঘাত' করেছেন।
একটি জাতীয় সংবাদমাধ্যম আয়োজিত আলোচনাচক্রে শুক্রবার যোগ দিয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। সেখানে আলোচনা হচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে এবং সার্বিকভাবে রাজ্য রাজনীতিতে ধর্মীয় ভাবাবেগকে ব্যবহার করা নিয়ে।
বিজ্ঞাপন
সেই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে হিন্দু ধর্মের অবতার রামচন্দ্র এবং দেবী দুর্গার তুলনা টেনে সভায় দিলীপ ঘোষ প্রশ্ন ছোঁড়েন, ‘ভগবান রাম একজন রাজা ছিলেন। কেউ তাকে অবতার বলেও মানেন। তার পূর্বপুরুষদের ১৪ প্রজন্মের কথাও জানা যায় - কিন্তু দুর্গার ক্ষেত্রে কি সেটা পাওয়া যায়?’
'রামচন্দ্র একজন রাজা ও আদর্শ পুরুষ ছিলেন। গান্ধীজিও রামরাজ্যের কল্পনা দিয়েছেন ভারতবাসীকে। সেখানে দুর্গা আসেন কোথা থেকে?’
বিজ্ঞাপন
বিজেপির রাজ্য সভাপতির বক্তব্যের এই অংশটি শুক্রবার রাতেই ভাইরাল হয়ে গেছে সামাজিক মাধ্যমে এবং তৃণমূল কংগ্রেস ওই মন্তব্যের কড়া নিন্দা জানিয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন দল বরাবরই আরাধ্য ঈশ্বর হিসেবে শ্রী রামচন্দ্রকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। দলের শীর্ষনেতারা অহরহ তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য-বক্তৃতায় ‘রামরাজ্য’ গঠণের প্রত্যয় জানান। এমনকি দলটির রাজনৈতিক স্লোগানও ‘জয় শ্রী রাম’।
পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা যেভাবে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন, রাজ্যে সেভাবে পূজিত হন না রামচন্দ্র। সেদিকে ইঙ্গিত করেই ওই মন্তব্য করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপির সভাপতি।
এদিকে শুক্রবারের ওই আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য কাকলি ঘোষ দস্তিদারও। সেখানেই তিনি বলেন যে বাঙালি হিন্দুদের পূজিত দেবী দুর্গাকে অপমান করেছেন বিজেপির নেতা।
"একজন ধর্মপ্রাণ দুর্গার উপাসক হিসাবে আমি অত্যন্ত ব্যথিত। অবাক হয়ে শুনলাম যে একটা জাতীয় রাজনৈতিক দলের রাজ্য সভাপতি এভাবে আরাধ্য দেবতাকে অপমান করতে পারলেন! এটা তো ধর্মীয় ভাবাবেগে সরাসরি আঘাত!" বলেন কাকলি ঘোষ দস্তিদার।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন,"যে দলটা নিজেদের হিন্দুধর্মের ধারক-বাহক বলে দাবি করে থাকে, তারা কী করে দেবী দুর্গাকে নিয়ে এরকম কথা বলে! আসলে ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসাই বিজেপির একমাত্র লক্ষ্য। তারা নিজেরা যে ধর্মপ্রাণ নয়, তাদের মনের গভীরে যে কথাগুলো ছিল, সেটাই বেরিয়ে এসেছে।"
কয়েক মাস পরে রাজ্যে যে বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে, তাতে তারা বিপুলভাবে জয়ী হবে বলে দাবি করছে বিজেপি। কিন্তু ভোটের পরিস্থিতিতে এরকম একটা বিতর্কিত মন্তব্য করে কি পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালিদের একাংশকে বিরূপ করে দেওয়া হল না?
এ প্রশ্নের উত্তরে বিজেপি নেতা অধ্যাপক পঙ্কজ রায় বলেন, "দুর্গা কোথা থেকে এলেন বলতে উনি ঠিক কী বুঝিয়েছেন সেটা আমি জানি না। তবে এরকম মন্তব্য করাটা উচিত নয় বলেই মনে করি।"
‘প্রত্যেক দেব-দেবীর মধ্যেই একটা প্রতীক লুকিয়ে থাকে। সেজন্যই আমরা রামচন্দ্রকে পুরুষোত্তম রাম বলি। অন্যদিকে দুর্গা অশুভ শক্তিকে বিনাশের প্রতীক। প্রতিটার অন্তর্নিহিত অর্থ আলাদা। সেটা বুঝতে হবে।’
ভারতীয় পুরাণ বিশারদ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী বলেন, যদি বিজেপি নেতা এটা মেনেই নেন যে রামচন্দ্রের বংশপরিচয় জানা যায়, তাহলে তার কথা অনুযায়ীই এটা তাদের মেনে নিতে হবে যে রামচন্দ্র কোনও ভগবান ছিলেন না - তিনি মানুষ ছিলেন আর দুর্গার সেই বংশপরিচয় নেই বলে তিনি ভগবান।
‘বংশপরিচয় থাকার জন্যই তো তিনি রামচন্দ্রকে মানুষ বলে মানছেন, ভগবান নন। আর যদি বলেন যে তিনি মনুষ্য রূপে ভগবান, তাহলে দুর্গাও মনুষ্য-রূপে আছেন। তিনিও বাপের বাড়ি আসেন, তারও পিতা পর্বতরাজ হিমালয়, তার সন্তানাদি আছে। দুর্গার বংশপরিচয় নেই কে বলল?’
নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ীর কথায়, এদের দুজনের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই উল্লেখ করে নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ি বলেন, ‘যদি মানব বা মানবী-কল্পনার কথা ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে দুজনেই ভগবান। এসব বিতর্ক কেন তৈরি করলেন দিলীপ ঘোষ? তিনি রাজনীতি করছেন - সেটাই করুন। তার মধ্যে ভগবান, রামচন্দ্র, দেবী দুর্গা – উনাদের কাউকে না আনাই ভাল।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন বিধানসভার ভোটের আগে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের মনীষীদের কেন্দ্র করে নানা অনুষ্ঠান পালন করে রাজ্যের মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করেছে - যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা স্বামী বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু অথবা চৈতন্যদেব।
আর এর ধারবাহিকতায় এবার রাজনীতির ময়দানে রামচন্দ্র এবং দুর্গাকেও নিয়ে আসা হল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসএমডব্লিউ