পুলিশের গুলিতে আহত এক বিক্ষোভকারীকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা

মিয়ানমারে গত ১ ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে এর বিরোধিতায় যে প্রতিবাদ-গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে তাতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ রক্তাক্ত একটি দিন ছিল শনিবার। ওইদিন দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের গুলি, টিয়ারগ্যাস এবং তাজা গুলিবর্ষণে অন্তত দু’জনের প্রাণহানি ঘটে এবং আহত হন ২০ জনের বেশি।

দেশটির ক্ষমতাচ্যুত ও গৃহবন্দি নেত্রী অং সান সু চির মুক্তি এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে টানা বিক্ষোভ করে আসছেন লাখ লাখ মানুষ। মিয়ানমারের বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন। এখন পর্যন্ত দেশটিতে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ এই শহরে অনুষ্ঠিত হলেও বিক্ষোভকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সহিংসতা দেখা যায়নি।

কিন্তু মান্দালয় এবং দেশটির অন্যান্য অঞ্চলে বিক্ষোভের ক্ষেত্রে এই গল্প ভিন্ন; যেখানে পুলিশ ও সেনাবাহিনী বিক্ষোভকারীদের সহিংস উপায়ে দমনের চেষ্টা করছে, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর এই সহিংসতা আরও বেড়েছে। রোববারও মান্দালয়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে সেনাশাসনবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন।

মান্দালয়ে শনিবারের বিক্ষোভে সম্মুখসারিতে ছিলেন দেশটির একজন চিকিৎসক। নাম প্রকাশ না করার শর্ত রোববার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া এক স্বাক্ষাৎকারে সেখানকার পরিস্থিতিকে রণক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি।

মিয়ানমারে এবারের জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে প্রথম প্রাণ হারান থেওয়ে খাইং নামের এক তরুণী

তিনি এবং তার দলের সদস্যরা মান্দালয়ের বিক্ষোভে পুলিশকে জলকামান নিক্ষেপ, বিক্ষোভকারীদের বেধড়ক মারপিট, তাজা গুলি, রাবার বুলেট এবং টিয়ারগ্যাস ছুড়তে দেখেছেন। সামরিক সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে শুরু হওয়া বিক্ষোভ ক্রমান্বয়ে জোরাল হয়ে ওঠায় শনিবার সকালের দিকে মান্দালয়ের বন্দরে প্রথম সহিংসতার ঘটনা ঘটে।

ওই সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা একটি জাহাজ দখলে নেওয়ার পর সেখান থেকে মালামাল সরানোর কাজ শুরু করেন। বিক্ষোভকারীরা এই বন্দরের কাছে জমায়েত হয়ে রাস্তা আটকে দেওয়ায় পুলিশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। জাহাজের প্রধান কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনার পর বিক্ষোভকারীরা রাস্তার একপাশ দিয়ে পুলিশকে বন্দরে যেতে দিতে রাজি হয়।

উত্তেজিত জনতা বিক্ষোভের নেতাদের কথা শুনে পুলিশ এবং জল কামানের ট্রাক যাওয়ার জন্য রাস্তা করে দেয়। এর কিছুক্ষণ পর একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি জল কামানের ট্রাক হাজির হয়ে কোনও ধরনের সতর্কতা ছাড়াই বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গরম পানি ছুড়তে থাকে। এর পরপরই পুলিশ জনতাকে বেধড়ক মারপিট শুরু করে।

ওই চিকিৎসক বলেন, আমি নিজের চোখে দেখেছি, সেখানে একজন বয়স্ক নারী তার বাড়ি থেকে বিক্ষোভ দেখছিলেন। কিন্তু পুলিশ তার ওপর আক্রমণ চালায়। তিনি মাথায় গুরুতর আঘাত পান। পুলিশ আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য তার দলের চিকিৎসকদের ডেকে পাঠায়। পরে পুলিশ ভ্যানেই অন্তত দু’জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।

মান্দালয়ে আইনশৃঙ্খলবাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ

নিরাপত্তাহীনতার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মান্দালয়ের আন্দোলনকারী একজন শিক্ষার্থী বলেন, বিক্ষোভকারীরা ধরা পড়ার, মারধরের শিকার অথবা গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।

তিনি বলেন, একজনের মাথা ফেটে যায় এবং সেলাইয়ের দরকার হয়। অন্যজনের উরুতে দু’টি জখম ছিল। আমি যা দেখেছি তাতে জখমকে রাবার বুলেটের মনে হয়নি। ওই ব্যক্তির প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। আহত দু’জনকে জরুরি চিকিৎসার জন্য ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানালেও পুলিশ রাজি হয়নি।

পরে সেখান থেকে ওই চিকিৎসক এবং তার দলের সদস্যরা শহরের অন্য একটি সড়কে যান। সেখানকার পরিস্থিতি মান্দালয় বন্দরের চেয়ে আরও খারাপ বলে জানান তিনি। এই এলাকায় অনেকে ভয়াবহ জখম নিয়ে রাস্তায় পড়ে ছিলেন। একজনের পেটে বুলেটের জখম দেখতে পান। অন্য একজন চিকিৎসক তাকে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন।

মান্দালয়ে এখন সেনাবাহিনী-পুলিশ রাতের বেলা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের মারধর এবং আটক করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সামরিক সরকারের শাসন মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে অসহযোগ আন্দোলন করে আসা মান্দালয়ে সরকারি একটি আবাসিক ভবনের বাসিন্দাদের ওপর বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা আক্রমণ চালায়।

নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উপ-পরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, আলোচনার সময় ফুরিয়ে গেছে।

ওই শিক্ষার্থী বলেন, সরকারি কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরাও দেশজুড়ে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তবে তাদের অনেককে আটকের হুমকি দিয়েছে সামরিক বাহিনী। আন্দোলনের কর্মী এবং বিক্ষোভের আয়োজকরা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন বলে জানান তিনি।

ইয়াঙ্গুনে রাস্তা আটকে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ করছেন হাজারও মানুষ

তিনি বলেন, এখন জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন দেশের সরকারকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দরকার। এই অবস্থা চলতে থাকলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নেতৃত্বাধীন সরকার এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইংয়ের ভবিষ্যৎ কত খারাপ হতে পারে, এখন সেটি দেখানোর সময়।

হিউম্যান রাইটসের এই কর্মকর্তা বলেন, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সামরিক বাহিনী বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করছে। যা জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অভিযানের সময়ও দেখা গেছে।

সূত্র: আলজাজিরা, রয়টার্স।

এসএস