মাত্র একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে বিশ্বের শীর্ষ দ্বিতীয় ধনীর আসন থেকে ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানিকে টেনে তলানিতে নামানো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পরামর্শক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছে।

বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে দেওয়া এক বার্তায় মার্কিন এই প্রতিষ্ঠান শিগগিরই আরেকটি প্রতিবেদন আসছে বলে জানিয়েছে। এই প্রতিবেদন নতুন করে তোলপাড় সৃষ্টি করার মতো বড় হতে যাচ্ছে বলে জানালেও বিস্তারিত কোনও তথ্য দেয়নি হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ।

বিস্তারিত না জানিয়ে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ বলেছে, শিগগিরই নতুন প্রতিবেদন আসছে — আরেকটি বড়।

গত ২৪ জানুয়ারি গৌতম আদানির প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপের প্রতারণা নিয়ে চাঞ্চল্যকর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউইয়র্কভিত্তিক আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ। সেখানে বলা হয়, দশককাল ধরে শেয়ার কারসাজি এবং আর্থিক লেনদেনে প্রতারণা চালিয়ে আসছে আদানি গ্রুপ। কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দর বহু গুণ বাড়িয়ে এ গ্রুপ বিশাল সম্পদ গড়েছে। গত কয়েক বছরে আদানি গ্রুপের কোম্পানির শেয়ার ৫০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।

প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর থেকেই আদানি গ্রুপের সব কোম্পানির শেয়ারের দাম পড়তে শুরু করে; সেই পতন এখনও অব্যাহত আছে। এই দরপতনের জেরে ইতোমধ্যে কয়েক হাজার কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ খুইয়েছেন গৌতম আদানি।

হিনডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশের পর এখন পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ বা ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের সম্পদ হারিয়েছে আদানি গ্রুপ। 
মার্কিন বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ফোর্বসের বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের প্রকৃত সম্পদের হালনাগাদ তথ্যে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বের ২৪তম ধনী আদানি; যার সম্পদের পরিমাণ ৫০ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের আরেক ধনকুবের মুকেশ আম্বানিকে পেছনে ফেলে এশিয়ার শীর্ষ ধনীর তকমা নিজের করে নিয়েছিলেন গৌতম আদানি। একই সময়ে বিশ্বের দশম ধনী নির্বাচিত হন তিনি। কয়েক মাস পর গত সেপ্টেম্বরে ১৫৫ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ নিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী বনে যান আদানি।

স্কুল থেকে ঝরে পড়া গৌতম আদানি গত কয়েক বছর ধরেই ভারতের শীর্ষ ধনী শিল্পপতিদের একজন। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের বাসিন্দা এবং ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সঙ্গে ভালো বোঝাপড়া থাকায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অন্যতম ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিও তিনি।

এই রাজনৈতিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়েই গত কয়েক বছরে রীতিমতো ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল আদানি গ্রুপ। ৬০ বছর বয়সী গৌতম আদানি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী। তবে হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে সে সবই এখন বিগত দিনের সোনালী ইতিহাস গৌতম আদানি ও তার মালিকানাধীন আদানি গ্রুপের জন্য।

• আদানিকে টেনে নামানো কারা এই হিন্ডেনবার্গ?

কর্পোরেট বিশ্বে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ একটি পরিচিত নাম। এটি কর্পোরেট কোম্পানির অসঙ্গতি ও অন্যায়গুলো সামনে আনে এবং ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করে। ২০১৭ সালে হিন্ডেনবার্গ প্রতিষ্ঠা করেন নাথান অ্যান্ডারসন। এটি একটি ফরেনসিক আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। যেটি সম্পত্তির মালিকানা, আর্থিক চুক্তি এবং আমানত বিশ্লেষণ করে থাকে।

প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে বলা আছে, হিন্ডেনবার্গ ‘মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়’ যেমন— আর্থিক অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং অপ্রকাশিত আর্থিক লেনদেনগুলোর খোঁজ করে থাকে।

কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম খুঁজে পাওয়ার পর এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিন্ডেনবার্গ। এরপর আর্থিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাজ করতে থাকে এটি।

হিন্ডেনবার্গের প্রতিষ্ঠাতা নাথান অ্যান্ডারসন যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসার ওপর স্নাতক সম্পন্ন করেন। তিনি তার ক্যারিয়ার শুরু করেন ডাটা কোম্পানি ফ্যাক্টসেট রিসার্চ সিস্টেমে। সেখানে তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কাজ করেন।

নাথান অ্যান্ডারসন ২০২০ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নালকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওই আর্থিক ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলো খুবই সাধারণ মানের বিশ্লেষণ করছিল। সবগুলো প্রায় একই রকম ছিল।’

• হিন্ডেনবার্গের সাফল্য কেমন?

এখন পর্যন্ত হিন্ডেনবার্গের সবচেয়ে সাফল্য হলো ২০২০ সালে বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা নিকোলা কর্পোরেশনের অসঙ্গতি প্রকাশ করা। নাথান অ্যান্ডারসনের দাবি, নিকোলার অসঙ্গতি ধরে ‘বড় লাভ’ করেছেন তারা।

নাথান অ্যান্ডারসন জানিয়েছেন, নিকোলা কর্পোরেশন তার বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করতে একটি ভুয়া ভিডিও তৈরি করেছিল। ওই ভিডিওতে দেখানো হয়েছিল উচ্চগতিতে নিকোলার ট্রাক রেসিং করছে— এমনকি উঁচু পাহাড় থেকে সাবলিলভাবে নেমে আসছে।

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত নিকোলার প্রতিষ্ঠাতা ট্রেভর মিল্টনকে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। ২০২১ সালে প্রতারণার বিষয়টি নিয়ে কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে ১২৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে সমঝোতা করে।

নিকোলা ২০২০ সালের জুনে একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানি  হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং কয়েক মাস পর এর ভ্যালু ২৪ বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করে। কিন্তু বর্তমানে এ কোম্পানির ভেল্যু মাত্র ১ দশমিক ৩৪ ডলার। হিন্ডেনবার্গ জানিয়েছে নিকোলার সাবেক কর্মীরা অসঙ্গতি ফাঁস করতে তাদের সহায়তা করেন।

হিন্ডেনবার্গের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৬টি কোম্পানির অসঙ্গতি ফাঁস করেছে তারা। গত বছর টুইটারের বিরুদ্ধে স্বল্পকালীন কিন্তু পরবর্তীতে দীর্ঘকালীন অবস্থান নেয় হিন্ডেনবার্গ।

এসএস