চলতি মাসে তিনটি বড় মাইলস্টোন অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০ বছর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তিতে সারা দেশে এখন বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ।

একসময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পাওয়া বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক জিডিপি চার্টে স্থান করে নিয়ে ওপরের দিকে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। যা একই বছরে ভারতের জিডিপি’র দ্বিগুণ। এছাড়া করোনা মহামারির কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হওয়া হাতেগোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি।

দেশটির জিডিপি মাথাপিছু আয় প্রায় দুই হাজার ডলার। যা প্রায় ভারতের সমান। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ নিজের নামের পাশ থেকে এলডিসি তকমা তুলে ফেলবে এবং ভারতের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হবে।

এটা বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য আনন্দের খবর। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় ভিয়েতনাম যেভাবে দ্রুত অগ্রসর হয়েছে; একই গতিতে অগ্রসর হয়েছে বাংলাদেশও। এর অর্থ এটাই- ইচ্ছা থাকলে স্রোতের বিপরীতেও এগিয়ে যাওয়া যায়।

১৯৮৬ সালে বাজার ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার সাধন করেছিল ভিয়েতনাম। দেশটির এই সংস্কার কার্যক্রম ছিল ‘দই মই’ নামে পরিচিত। এর ফলে ভিয়েতনামে ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও শিল্পায়ন হয়। গার্মেন্টস ও কল-কারখানা প্রতিষ্ঠা করে দেশটি পোশাক উৎপাদন শুরু করে। উৎপাদনের তালিকায় ছিল মোবাইল ফোন ও ইলেকট্রনিক পণ্যও।

এরপর অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সাক্ষর করে নিজেকে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের অন্তর্ভুক্ত করে দেশটি। ১৯৯৫ সালে ভিয়েতনাম আঞ্চলিক জোট আসিয়ানে যোগ দেয়। এটা আসলে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল।

এছাড়া দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন ও জাপানের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। এর ফলে চাহিদা মতো মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে নিজ দেশের মানুষকে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেয় ভিয়েতনাম। এর পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্য স্বল্পমূল্যে সরবরাহ ও রফতানি বাড়ানোর মাধ্যমে নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে তারা।

বাংলাদেশও এই একই কৌশলে কাজ করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির উত্থানও হয়েছে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্পের হাত ধরে। দেশটির মোট রফতানি পণ্যের ৮০ শতাংশই আসলে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস পণ্য। এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। জাপানে বাংলাদেশ পায় শুল্কমুক্ত ও ক্ষেত্রবিশেষে স্বল্প শুল্কে বাণিজ্য সুবিধা।

এমনকি ভারতের সঙ্গেও রেডিমেড গার্মেন্টস পণ্যের মতো কয়েকটি পণ্যে শূন্য রফতানি শূল্ক উপভোগ করে ঢাকা। এর পাশাপাশি গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ নিজের কৃষি উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান, আবিষ্কার ও উত্তোলন, ওষুধ উৎপাদন ও রফতানি এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়েছে।

ভিয়েতনামের মতো বাংলাদেশেও বিদেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা ও পদ্ধতি বিনিয়োগকারীর জন্য সুবিধাজনক। বিনিয়োগকারীরা স্থানীয় বিভিন্ন কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের মতোই সমান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। আর এ কারণে ভারতীয় কোম্পানিগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে দেশটিতে ঢুকছে। এছাড়া বাংলাদেশিদের কাছে ভারতীয় পণ্য খুবই জনপ্রিয়।

ক্ষুদ্রঋণের বিষয়ে বিশ্বের সকল উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার ওপরে। এই মডেলটিও বাংলাদেশের আবিষ্কার করা। ব্রাক ও গ্রামীন ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান সমগ্র বাংলাদেশজুড়ে ক্ষুদ্র ব্যবসার উন্নয়নে কাজ করছে। একই কাজ আঞ্চলিকভাবেও করছে অনেক প্রতিষ্ঠান।

নারীদের উন্নয়নেও বাংলাদেশের অবস্থান অগ্রগণ্য। নারীদেররকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার পাশাপাশি ঘরের বাইরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও তাদেরকে সম্পৃক্ত করতে নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। দেশের টেক্সটাইল শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের ৯৫ শতাংশই নারী।

এছাড়া দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সফলতার সঙ্গে দায়িত্বপালনও করছেন একজন নারী, শেখ হাসিনা। তিনি একজন সফল সরকারপ্রধান।

এর পাশাপাশি ‘পুষ্টি আপা’ স্কিম এবং দেশব্যাপী কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠারও সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ। শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, স্যানিটেশন, ক্ষুধা ও লিঙ্গ সমতার দিক থেকে ভারতসহ অন্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের উন্নয়নের এই সফল গল্প থেকে ভারত, দক্ষিণ এশিয়াসহ পুরো বিশ্ব কী শিখতে পারে?
‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে উন্নয়নের অগ্রযাত্রার তালিকায় ওপরের দিকে উঠে আসা বাংলাদেশের কাছ থেকে বিশ্বের সকল দেশেরই শেখার আছে। অভ্যন্তরীণ ও রফতানি বাণিজ্য সহজীকরণ, ক্ষুদ্রঋণ সহজলভ্য করাসহ বেশ অনেক কিছুই শেখার আছে।

দেশটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। এর জন্য প্রয়োজন অবকাঠামো, যোগাযোগের সুবিধা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ। এর সবই আছে বাংলাদেশে। এছাড়া দেশীয় উদ্যোক্তারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার প্রসার ঘটাচ্ছেন। এর সঙ্গে সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থান ও নতুন নতুন আবিষ্কার।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুইদিনের সফরে শুক্রবার (২৬ মার্চ) ঢাকায় আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই সফরে তিনি দু’দেশের সম্পর্ককে আরও ভালো অবস্থানে নিয়ে যাবেন।

গত সপ্তাহে এক সেমিনারে ব্রাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মানসুর বলেছেন, ‘যোগাযোগের স্বল্পতায় ১৯৪৭ সাল থেকে উভয় দেশ অনেক ভুগেছে। এর জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। আর তাই সমন্বিত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, মুক্ত বাণিজ্য ও ভিসা ব্যবস্থা আরও সহজ করার উপযুক্ত সময় এখনই।’

দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের দায়িত্ব সবসময় ভারতের একার কাঁধে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ভারতের এখন একটি যোগ্য সহযোগী আছে। যার সঙ্গে উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর ভাবে কাজ করতে পারে নয়াদিল্লি।

• ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে লেখা মনজিৎ ক্রিপালানি, রাজিব ভাটিয়া এবং স্যাগনিক চক্রবর্তীর নিবন্ধ অবলম্বনে।

টিএম