বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান পথ সুয়েজ খাল প্রায় এক সপ্তাহ ধরে আটকে রাখা জাহাজ এভার গিভেন ভেসেছে ঠিকই; কিন্তু ওই জাহাজের অন্তত ২৫ ভারতীয় নাবিকের জন্য অপেক্ষা করছে চরম অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ। জাহাজটি কেন সুয়েজে আটকে গিয়েছিল, তা নিয়ে এখন মিসর কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে।

বিশালাকার কার্গো জাহাজটি জাপানের মালিকানাধীন পানামার পতাকাবাহী এবং তাইওয়ানের এভারগ্রিন কোম্পানি পরিচালিত হলেও জাহাজের ক্যাপ্টেন-সহ নাবিকদের সবাই ছিলেন ভারতীয় নাগরিক। বিবিসি বলছে, সুয়েজ খালের ওই দুর্ঘটনার পর ভারত সরকার তাদের সবার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আশ্বস্ত করেছে যে ওই নাবিকদের সুরক্ষার জন্য তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।

কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন বা অন্য নাবিকদের পরিচয় তারা এখনও প্রকাশ করেননি। যদিও নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, ওই ২৫ ভারতীয় নাবিকের বেশির ভাগই ছিলেন দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের তেলেঙ্গানা, কেরালা বা তামিলনাডু রাজ্যের বাসিন্দা। ক্যাপ্টেন নিজেও একজন দক্ষিণ ভারতীয়। এখন ভারতের জাহাজ চলাচল শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের অনেকেই মনে করছেন, সুয়েজের ওই দুর্ঘটনার জেরে ভারতীয় নাবিকদের ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি হতে হবে।

ওই ২৫ নাবিককে সুয়েজে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের তদন্ত শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তাদের দেশ ছাড়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। 

ভারতে মার্চেন্ট নেভি অফিসারদের বৃহত্তম সংগঠন দ্য মেরিটাইম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়ার একটি উচ্চ পর্যায়ের সূত্র বিবিসিকে বলেন, আসলে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব কিছু আইনকানুন আছে; যা আন্তর্জাতিক মেরিটাইম বা সমুদ্র আইনের চেয়েও অনেক বেশি কড়া! যেমন ধরুন, যখনই কোনও জাহাজ ওই খালে প্রবেশ করবে তার আগে থেকেই কর্তৃপক্ষের নিজস্ব দুই পাইলট জাহাজে উঠে দায়িত্ব নেবেন এবং পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

তিনি বলেন, কিন্তু তারপরও জাহাজ যদি কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে সেক্ষেত্রে তার দায় জাহাজের ক্যাপ্টেনের ওপরই বর্তাবে; ওই পাইলটদের ওপর নয়। ভারতের জাহাজ চলাচল শিল্পের আশঙ্কা, এই কারণেই দুর্ঘটনার দায় শেষ পর্যন্ত ভারতীয় নাবিকদের ওপরেই পড়ার একটা শঙ্কা রয়েছে।

গত ২৩ মার্চ সকালে এভার গিভেন যখন সুয়েজ খাল ধরে এগোচ্ছিল, তখন প্রবল ধূলিঝড় আর প্রবল বাতাসে জাহাজটির অভিমুখ বেঁকে যায় বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায় এবং সেটি খালকে আড়াআড়িভাবে আটকে দেয়। এর পরিণতিতে প্রায় সাড়ে তিনশ মালবাহী জাহাজ খালের দু’দিকে আটকে পড়ে। বহু জাহাজকে কেপ টাউন হয়ে পুরো আফ্রিকা ঘুরে ইউরোপের দিকে পাড়ি দিতে হয়।

ভারতের ন্যাশনাল শিপিং বোর্ডের সদস্য ক্যাপ্টেন সঞ্জয় পরাশর বলছেন, ঠিক কীভাবে জাহাজটি খালকে আটকে দিল তার তো তদন্ত হবেই। এটা সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এখানে ভারতীয় নাবিকদের দায় কতটা, জাহাজের শিপ ভয়েজ ডেটা রেকর্ডার থেকে কথোপকথন শুনলেই তা পরিষ্কার হবে বলে মনে করি।

দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিক পি সুশীল রাও ওই জাহাজের ভারতীয় নাবিকদের নিয়ে খোঁজখবর রাখছেন প্রথম থেকেই। তিনি বলেন, আমি যতদূর জানতে পারছি জাহাজটির জাপানি মালিকদের সঙ্গে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের এই মুহূর্তে আর্থিক ক্ষতিপূরণ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে।

‌‌‘সেই আলোচনা ফলপ্রসূ হলে এই সঙ্কট হয়তো সহজেই মিটে যাবে এবং ভারতীয় নাবিকরা হয়তো কড়া শাস্তি এড়াতে পারবেন। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত হবে কি না, তা অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করছে।’

এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই মুম্বাইভিত্তিক ‘ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সিফেয়ারার্স অব ইন্ডিয়া’ এভারগিভেন জাহাজের সব ভারতীয় নাবিকের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে তাদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবদুলগনি সেরাং টুইট করেছেন, আমি ওই নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা সুস্থ আছেন, কিন্তু প্রচণ্ড চাপের মুখে আছেন।তবে তারা এই বিপদে একা নন। যখনই দরকার হবে এবং যেভাবে দরকার হবে, আমরা তাদের সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি।

ওই নাবিকদের আইনি সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও কূটনৈতিক চ্যানেলে অনানুষ্ঠানিকভাবে মিসরের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।

এসএস