দীর্ঘদিনের জিইয়ে রাখা তীব্র কূটনৈতিক টানাপোড়েনের মাঝে আলোচনার টেবিলে বসছেন উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। রক্ষণশীল সুন্নি রাজতন্ত্রের দেশগুলোর এই জোট আগামী মঙ্গলবার বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেলের উৎপাদনকারী সৌদি আরবে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে। 

সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতারের সমন্বয়ে গঠিত এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোটের সঙ্গে শিয়া অধ্যুষিত ইরানের সম্পর্ক বিপরীতমুখী।

ইরানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্কের মাঝে ২০১৭ সালের ৫ জুন সৌদি আরব, আমিরাত এবং বাহরাইন ছাড়াও জিসিসির জোটের বাইরের মিসর, মালদ্বীপ কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।

সৌদি নেতৃত্বাধীন এসব দেশ দোহার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে সহায়তা এবং ইরান ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ এনে এই দেশটির বিরুদ্ধে স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে অবরোধ আরোপের ঘোষণা দেয়। 

যদিও গ্যাস-তেল সমৃদ্ধ উপসাগরীয় অঞ্চলের এই ক্ষুদে রাষ্ট্র সব ধরনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের নজিরবিহীন এই সঙ্কটেও কাতারের সঙ্গে কুয়েত এবং ওমান সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্কটের সমাধানে কুয়েত মধ্যস্থতার চেষ্টা করলেও তাতে আশার আলো দেখা যায়নি।

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের দুই বছর পর ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ১৯৮১ সালের মে মাসে যাত্রা শুরু করে জিসিসি। শিয়া অধ্যুষিত ইরানের ইসলামি বিপ্লব সুন্নি-সংখ্যাগরিষ্ঠ উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোকে নাড়িয়ে দেয়। এই অঞ্চলের ছয়টি দেশের মোট জনসংখ্যা ৫ কোটি ২০ লাখের বেশি; যাদের বেশিরভাগই প্রবাসী। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র কুয়েত এবং বাহরাইনের নির্বাচিত সংসদ রয়েছে।

১৯৮৪ সালে পেনিনসুলা শিল্ড নামে একটি সামরিক জোট গঠন করে জিসিসি। জোট গঠন করা হলেও ১৯৯০ সালে ইরাকে কুয়েতের আক্রমণ ঠেকাতে পারেনি তারা। 

একই বছর কুয়েত থেকে সাদ্দাম হুসেইনের সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী। পরে জিজিসি সদস্য রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বড় ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে।

২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় একমাত্র বাহরাইন ছাড়া অন্যান্য সব দেশে গড়ে ওঠা গণতন্ত্রপন্থীদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় জিসিসি রাষ্ট্রগুলো। সাংবিধানিক রাজতন্ত্র এবং নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে বাহরাইনের ক্ষমতাসীন রাজপরিবার।

বাহরাইনে সামরিক বাহিনীর কঠোর অভিযানে কয়েক ডজন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া দেশটিতে কয়েকশ মানুষকে আটক করা হয়; যাদের বেশিরভাগই শিয়া মতাবলম্বী মানবাধিকার কর্মী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাহরাইনের সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করতে দেশটিতে জিসিসি সৈন্য মোতায়েন করা হয়।

সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে সবার অংশগ্রহণে একটি বাজার, কাস্টমস ইউনিয়ন, একই মুদ্রা-কেন্দ্রীয় ব্যাংক গঠনের অনুমোদন দেয় জিসিসি। সেই সময় নেয়া এসব সিদ্ধান্তের অধিকাংশই এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।

এর পাশাপাশি জিসিসিভূক্ত দেশগুলোতে নাগরিকদের অবাধ চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। যদিও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নানা ধরনের বিধি-নিষেধ এখনও রয়েছে। বৈচিত্রতা আনার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও জিসিসির অর্থনীতি এখনও তেল রাজস্বের ওপর নির্ভরশীল। 

এই জোটের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ আয় তেলের রাজস্ব থেকে আসে।

বিশ্বের অপরিশোধিত তেলের সরবরাহের এক পঞ্চমাংশ আসে জিসিসির ছয় সদস্য রাষ্ট্র থেকে। ২০১৪ সালে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম পড়ে যাওয়ার পর এসব দেশ সরকারি ব্যয় পরিচালনার জন্য বিশাল অংকের ঋণ নিতে বাধ্য হয়।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রথমবারের মতো পণ্য ও সেবার ওপর পাঁচ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর আরোপ করে। পরবর্তীতে বাহরাইন এবং ওমানও সৌদি-আমিরাতের পথ অনুসরণ করে মূল্য সংযোজন কর আরোপ করে। জিসিসির মোট অর্থনীতির ৭৫ শতাংশই সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের।

করোনাভাইরাস মহামারি গত বছর তেলের দামের পতন আরও বৃদ্ধি করে; যা এখনও অস্থিতিশীল রয়েছে বলে ডিসেম্বরে সতর্ক করে দেয় 

২০২০ সালে জিজিসির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। জিডিপির এই সঙ্কোচন গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)

গত বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক স্থাপন করে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন। অনেক বিশ্লেষক ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সৌদি আরব এবং ওমানও একই পথে হাঁটতে পারে।

সূত্র: এএফপি।

এসএস