মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়-অ্যাস্ট্রােজেনেকা এবং ভারত বায়োটেকের তৈরি পৃথক দুটি ভ্যাকসিন প্রয়োগের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে ভারত। রোববার দেশটির ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়া (ডিসিজিআই) এই দুটি ভ্যাকসিন জরুরি প্রয়োগের অনুমোদন দেয়।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোভিশিল্ড নামের এই করোনা ভ্যাকসিন ভারতের পুনের সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া উৎপাদন করছে। সিরাম এবং হায়দরাবাদভিত্তিক ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেক ভ্যাকসিন দুটি প্রয়োগের অনুমতি চেয়ে ডিসিজিআইয়ের কাছে আবেদন করেছিল। পরীক্ষার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের পর রোববার ভ্যাকসিন দুটি সীমিত পরিসরে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে। 

জরুরি প্রয়োগের জন্য দেশটির সরকারের গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেল একদিন আগে ব্রিটিশ ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগে সুপারিশ করে।

বিশেষজ্ঞ প্যানেলের জরুরি প্রয়োগের সুপারিশ ভারতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়ার (ডিসিজিআই) দফতরে পাঠানার দুদিন পর দেশটিতে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমতি দেয়া হলো।

শনিবার সকালের দিকে সংবাদ সম্মেলনে ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন বলেছিলেন, ডিসিজিআই এই সুপারিশের ব্যাপারে শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেবে। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের সুরক্ষার ব্যাপারে আশ্বাস দেন এই মন্ত্রী। 

অ্যাস্ট্রােজেনেকা-অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রায় ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে ভারত বায়োটেকের ভ্যাকসিনটি নিরাপদ এবং শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম

ডিসিজিআইয়ের প্রধান ভি. জে সোমানি

রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে ডিসিজিআইয়ের এই প্রধান বলেন, এম/এস সিরাম এবং এম/এস ভারত বায়োটেকের ভ্যাকসিন দুটি জরুরি পরিস্থিতিতে সীমিত পরিসরে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বিবৃতি পাঠ করলেও সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি।

এদিকে, দেশে করোনার দুটি ভ্যাকসিনের অনুমোদনকে স্বাগত জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেছেন, ভারতে তৈরি দুটি ভ্যাকসিনের জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন প্রত্যেক ভারতীয়কে গর্বিত করবে। ভ্যাকসিনের এই অনুমোদন ‘ভারতের স্বনির্ভরতার প্রতীক’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

ভারতের সরকারি মেডিক্যাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের (আইসিএমআর) সহায়তায় হায়দরাবাদভিত্তিক কোম্পানি ভারত বায়োটেক কোভ্যাক্সিন তৈরি করছে। যদিও এই ভ্যাকসিনের কায়কারিতা এবং সুরক্ষার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত বিস্তারিত কোনও তথ্য জানা যায়নি। তবে ভারত বায়োটেক বলছে, ওষুধ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের কাছে পরীক্ষার সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত জমা দিয়েছে তারা। 

করোনার উত্থান এবং বৈশ্বিক মহামারি

• গত বছরের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়।

• চীনে করোনায় প্রথম প্রাণহানি ঘটে ৯ জানুয়ারি।

• ১৩ জানুয়ারি চীনের বাইরে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় থাইল্যান্ডে।

• এই ভাইরাসে বিশ্বে প্রথম প্রাণহানি ঘটে ২ জানুয়ারি ফিলিপাইনে।

• ১১ মার্চ ‌‘করোনা মহামারি’ ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিনের আদ্যোপান্ত 

৩০ জুন ২০২০- স্থানীয়ভাবে তৈরি দেশের প্রথম করোনা ভ্যাকসিন ‌‌‘কোভ্যাক্সিন’ মানবদেহে পরীক্ষার অনুমোদন দেয় ডিসিজিআই।

৩ জুলাই- ভারতের শীর্ষস্থানীয় মেডিক্যাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিএমআরের এক কর্মকর্তার গোপন চিঠি ফাঁস হয়। এতে দেখা যায়, দেশটির স্বাধীনতা দিবস ১৫ আগস্ট করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। এই চিঠি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর দেশটির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা রাজনৈতিক কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তা বিপজ্জনক হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন। 

একই দিনে ভারত বায়োটেক পরীক্ষা সফল হলে ৩০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হবে বলে নিজেদের লক্ষ্যমাত্রার কথা জানায়।

৪ জুলাই- আইসিএমআর বলছে, আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে দ্রুতগতিতে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করছে ভারত বায়োটেক।  

২৩ অক্টোবর- ভারত বায়োটেক জানায়, বিশ্বের ১০টিরও বেশি দেশ কোভ্যাক্সিন নেয়ার ব্যাপারে নিজেদের আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় ভ্যাকসিনটি নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে বলেও ওইদিন জানানো হয়।

১ নভেম্বর- ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধ্বে ভ্যাকসিন বাজারের আনার পরিকল্পনার কথা জানায় ভারত বায়োটেক।  

১৬ নভেম্বর- মানবদেহে তৃতীয় ধাপে ভ্যাকসিনটির পরীক্ষার শুরু হয়েছে বলে জানায় হায়দরাবাদের এই প্রতিষ্ঠান।  

৭ ডিসেম্বের- কোভ্যাক্সিনের জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন চায় ভারত বায়োটেক। 

২২ ডিসেম্বর- যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতের তৈরি এই ভ্যাকসিন সরবরাহ ও উৎপাদনের জন্য ভারত বায়োটেকের সঙ্গে চুক্তি করে মার্কিন ওষুধপ্রস্তুতকারক কোম্পানি ওকিউজেন ইনকরপোরেশন।

২ জানুয়ারি- ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ জনস্বার্থ বিবেচনায় জরুরি পরিস্থিতিতে পূর্ব-সতর্কতা অবলম্বন করে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমোদন দেয়।

ভারত বায়োটেক বলছে, ভারতে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা গত নভেম্বরে শুরু হয়েছে। এই পরীক্ষায় ২৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে অন্তর্ভূক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও এখন পর্যন্ত ২৩ হাজার স্বেচ্ছাসেবী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন।

ভারতে মহামারি এই ভাইরাসে এখন পর্যন্ত এক কোটি ৩২ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন; যা বিশ্বের একক কোনও দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

দুই কোটি ৯০ লাখের বেশি আক্রান্ত নিয়ে এই মহামারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারতে করোনায় এক লাখ ৪৯ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও যুক্তরাষ্ট্রে সেই সংখ্যা ৩ লাখ ৫৮ হাজার ছাড়িয়েছে।

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হওয়ার পর বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ঢেউ চলছে। বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ কোটি ৪৯ লাখ ৯৩ হাজারের বেশি মানুষ এবং মৃত্যু ছাড়িয়েছে ১৮ লাখ ৪৩ হাজার। 

সূত্র : রয়টার্স, এনডিটিভি।

এসএস