ট্রাম্পের এই বিদায় ইতিহাস কীভাবে মনে রাখবে?
এভাবেই শেষ হলো প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদ! কোনো আবেগঘন মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে নয়, বরং উত্তাল ও সহিংস পরিস্থিতির মধ্য হলো এই বিদায়। ইতিহাস কীভাবে ট্রাম্পের এই বিদায় মনে রাখবে?
কয়েক সপ্তাহ ধরেই ডোনাল্ড ট্রাম্প বলে আসছিলেন ৬ জানুয়ারি হতে যাচ্ছে ‘বোঝাপড়ার দিন’। এর সূত্র ধরেই প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে জড়ো হয়ে কংগ্রেস ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সমর্থকদের ডাক দেন ট্রাম্প। বুধবার (৬ জানুয়ারি) সকাল থেকেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে এবং তার সমর্থকরা মাঠ গরম করতে শুরু করেন।
বিজ্ঞাপন
ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী রুডি জুলিয়ানি বলেন, নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে বিতর্কের মামলা জিততে হবে ‘সম্মুখ যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে’।
অন্যদিকে দলের যেসব সদস্য ট্রাম্পের হয়ে ‘লড়বে’ না, তাদের লক্ষ্য করেও বার্তা দেন প্রেসিডেন্টের বড় ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়ার। তিনি বলেন,‘এটা এখন আর তাদের রিপাবলিকান পার্টি নয়। এটা এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি।’
বিজ্ঞাপন
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেও ক্রমেই বাড়তে থাকা সমর্থকদের উৎসাহ দিয়ে বলেন, হোয়াইট হাউস থেকে ক্যাপিটল হিল; এই দুই মাইল পথ মিছিল করে যেতে হবে। প্রেসিডেন্টের উৎসাহে উজ্জীবিত বিক্ষোভকারীদের মুখে তখন চলছে ‘চুরি বন্ধ করো’ এবং ‘বুলশিট’ স্লোগান।
প্রেসিডেন্ট বলেন,‘আমরা ছাড়ব না। আমরা পরাজয় মেনে নেব না। আমাদের দেশ অনেক সহ্য করেছে। আর সহ্য করতে আমরা রাজি নই।’
প্রেসিডেন্ট যখন তার বক্তব্য শেষ করছেন, তখন ক্যাপিটল হিল ভবনের ভেতরে অন্য এক নাটকীয় ঘটনার জন্য মঞ্চ প্রস্তুত হচ্ছিল। কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে গত ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে প্রতিটি রাজ্যের ফলাফল সার্টিফিকেশন বা প্রত্যয়নের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল।
এর আগে বিতর্কিত রাজ্যগুলোর নির্বাচনী ফলাফল অগ্রাহ্য করতে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে ট্রাম্পের সেই আহ্বান উপেক্ষা করে মাইক পেন্স বলেন, এই ধরনের কাজ করার কোনো ক্ষমতা তার নেই এবং এই অধিবেশনে তার ভূমিকা ‘মূলত আনুষ্ঠানিক’।
এরপর রিপাবলিকানরা তাদের অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের ভোট জালিয়াতি হয়েছে বলে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। এই পর্যায়ে হাউস ও সিনেট সদস্যরা ওই রাজ্যে বাইডেনের বিজয় গ্রহণযোগ্য কিনা তা নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে তাদের মতামত উপস্থাপন শুরু করেন। প্রতিনিধি সভার অধিবেশন ছিল খুবই উত্তপ্ত। নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপনের সময় উভয় পক্ষের সদস্যরা নিজ দলের বক্তার যুক্তি সমর্থন করে চিৎকার করছিলেন, ধ্বনি দিচ্ছিলেন। এক কথায় খুবই উত্তেজিত পরিবেশে কংগ্রেসে বাকযুদ্ধ চলছিল।
এরই মধ্যে কংগ্রেসে নবনির্বাচিত এক নারী সদস্য লরেন বোওবার্ট বলেন,‘গত রোববার সংবিধান সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করে আমি যে শপথ গ্রহণ করেছি, তার আলোকে ভুয়া এবং বানোয়াট পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আপত্তি জানানোটা আমার দায়িত্ব। জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করতে দেওয়া যাবে না।’
কংগ্রেসে যোগ দেবার সময় নিজের হ্যান্ডগান (বন্দুক) সঙ্গে রাখার ঘোষণা দিয়ে সম্প্রতি আলোচনায় আসেন এই নারী কংগ্রেস সদস্য।
ওদিকে সিনেটে বিতর্কের মেজাজ তখন আলাদা রূপ নিয়েছে। সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা রিপাবলিকান মিচ ম্যাককনেল তখন বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন- প্রেসিডেন্টের প্রশংসার বদলে যেন ট্রাম্পকে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করতেই হাজির হয়েছেন তিনি।
ম্যাককনেল বলেন,‘পরাজিত দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ তুলে এই নির্বাচনের ফলকে যদি এখন উল্টে দেয়া হয়, তাহলে সেটা আমাদের গণতন্ত্রের জন্য কবর খোঁড়া হবে। এরপর আমাদের গোটা জাতি আর কখনও কোনো নির্বাচনের ফল মেনে নেবে না।’
নির্বাচন শেষে আবেগ যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, এই ক্রোধের আগুনে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি যেন ধ্বসে না পড়ে
রিপাবলিকান সিনেটর মিচ ম্যাককনেল
তিনি যখন এই কথাগুলো বলছেন, তখন ক্যাপিটল ভবনের বাইরে ক্ষোভের আগুন টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছে। সেখানে মোতায়েন অল্প সংখ্যক নিরাপত্তা কর্মীদের বাধা সহজেই ডিঙিয়ে ট্রাম্প সমর্থকরা ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং সভার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আইনপ্রণেতারা, সেখানকার কর্মচারী ও সংবাদকর্মীরা হামলাকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছোটাছুটি শুরু করেন।
ঘটনা নাটকীয় মোড় নিতে থাকে ধাপে ধাপে। সেখানে যে টেলিভিশন সম্প্রচার চলছিল, সেই ক্যামেরায় দেখা যায়, ক্যাপিটল ভবনের সিঁড়িতে উঠে বিক্ষোভকারীরা পতাকা দোলাচ্ছে এবং নাচানাচি করছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীরা ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়েছে, তারা লেজিসলেটিভ চেম্বারের ভেতর দরজা ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করছে, তাদের কেউ কেউ নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের দপ্তরের কর্মী বা নিরাপত্তা কর্মীর পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। প্রতিবন্ধক দিয়ে আটকানো দরজার ওপারে প্রতিনিধি সভার ভেতরে বন্দুক নিয়ে তারা ঢুকে পড়ে।
একই সময়ে ডেলাওয়ারের উইলমিংটনে অর্থনীতি বিষয়ে একটি ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনায় সেটা তিনি বাতিল করে দেন এবং এটাকে ওয়াশিংটনে একটা ‘‘বিদ্রোহ’’ আখ্যা দিয়ে এই তাণ্ডবের নিন্দা করেন।
বাইডেন বলেন,‘আমাদের গণতন্ত্র নজিরবিহীন হামলার মুখে পড়েছে। নিকট অতীতে এ ধরনের আক্রমণ আমাদের গণতন্ত্রের ওপর আসেনি।’
ট্রাম্পের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বাইডেন বক্তব্য শেষ করেন। তিনি বলেন,‘আপনি (ট্রাম্প) জাতীয় টেলিভিশনে গিয়ে এই সহিংসতার নিন্দা করুন এবং এই অবরোধ অবসানের দাবি জানান।’
এর কয়েক মিনিট পরে ট্রাম্প জাতির উদ্দেশ্যে একটি বার্তা দেন। কিন্তু জো বাইডেন যা চেয়েছিলেন তা তিনি বলেননি। এসময় তার বহু পরিচিত অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করে ট্রাম্প বলেন, নির্বাচন ‘চুরি’ করা হয়েছে। এরপর তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন,‘আপনারা ঘরে ফিরে যান, আমরা আপনাদের ভালবাসি, আপনারা সবাই খুবই বিশেষ মানুষ।’
ওয়াশিংটনের তাণ্ডবের পর ট্রাম্পের টুইট এবং তার সমর্থকদের প্রশংসা করে এরপর আরও দুটি টুইট বার্তা সরিয়ে ফেলে টুইটার। এরপর নজিরবিহীন এক পদক্ষেপের মাধ্যমে ১২ ঘণ্টার জন্য প্রেসিডেন্টের টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয় সংস্থাটি। এর পরপরই ফেসবুকও ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার পর পুলিশ শেষ পর্যন্ত ক্যাপিটল ভবনে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। বাম শিবির, ডান শিবির সব দিক থেকে সমস্বরে এই সহিংসতার ঘটনায় নিন্দার ঝড় বইতে শুরু করে। ডেমোক্র্যাট সিনেটের চাক শুমার এই দাঙ্গা ও তাণ্ডবের দায় চাপান প্রেসিডেন্টের ওপর।
তিনি বলেন,‘আমেরিকার ইতিহাসে ৬ জানুয়ারি অন্যতম একটা কালো দিন হিসাবে লেখা থাকবে। একজন প্রেসিডেন্ট যখন আবেগকে উস্কে দিয়ে দেশ শাসন করেন তখন তার পরিণতি কী হতে পারে এটা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। যারা তাকে এই পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করেন, যেসব সংবাদমাধ্যম তার মিথ্যা বক্তব্য তোতা পাখির মত সম্প্রচার করে, আর আমেরিকাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে সহাযতা করে- এই ঘটনা তাদের জন্য চরম সতর্কবাণী।
অনেক রিপাবলিকানও এই ঘটনার পর একই ধরনের মন্তব্য করেছেন।
টুইটারে দেওয়া বার্তায় কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্য লিন চেইনি বলেন,‘আমরা যারা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছিলাম, আমাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টায় উচ্ছৃঙ্খল জনতা ক্যাপিটল ভবনের ওপর সহিংস আক্রমণ চালিয়েছে। এই উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সংঘবদ্ধ করেছেন প্রেসিডেন্ট। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তিনিই এই জনতাকে উস্কে দিয়েছেন। তিনিই এই জনতার উদ্দেশে কথা বলেছেন।’
নির্বাচনের ফল মেনে নেওয়ার সময় পার হয়ে গেছে। আর কতদিন? আমেরিকার মানুষকে বিভ্রান্ত করা ছেড়ে দিন, জনতাকে খেপিয়ে তোলা বন্ধ করুন
আরকানসাসের সিনেটার টম কটন
ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের চিফ অব স্টাফ স্টেফানি গ্রিশাম এবং হোয়াইট হাউসের উপ-তথ্য সচিব সারা ম্যাথিউস প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসনের আরও কর্মকর্তা আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবাদ স্বরূপ পদত্যাগ করবেন।
তবে এতো সব কিছুর পরও ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে বহাল আছেন। হয়তো তার টুইটার, ফেসবুক যতক্ষণ বন্ধ থাকবে তিনি হোয়াইট হাউসে টিভির সামনে বসে সময় কাটাবেন, কিন্তু বেশিদিন তিনি চুপ করে থাকবেন না।
হোয়াইট হাউসের পাট গুটিয়ে যখন তিনি ফ্লোরিডায় তার নতুন বাসভবনে গুছিয়ে বসবেন, তখন তিনি কার সাথে কীভাবে বোঝাপড়া করবেন সেই পরিকল্পনার ছক কাটবেন। এবং কে বলতে পারে, আবার তখন ফিরে আসবেন ক্ষমতায়।
এই মেয়াদে তার রেখে যাওয়া ভাবমূর্তি শেষ দিনগুলোয় যেভাবে কালিমালিপ্ত হয়েছে, হয়তো তখন তাকে নতুন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করবেন ট্রাম্প।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিএম