তৃতীয় লিঙ্গের প্রথম ডা. ভিএস প্রিয়ার চ্যালেঞ্জ জয়ের গল্প
• সমাজের ভ্রু কুঁচকানোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্বপ্ন জয় প্রিয়ার
• ভারতের কেরালার রাজ্যের তৃতীয় লিঙ্গের প্রথম চিকিৎসক তিনি
• ২০১৩ সালে ওল্লুরের বিদ্যারত্ম আয়ুর্বেদিক কলেজে ভর্তি হন
• ২০১৮ সালের শেষে সিতারাম আয়ুর্বেদ হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন
• পরবর্তীতে মেঙ্গালুরু থেকে মেডিসিন ডক্টর (এমডি) শেষ করেন তিনি
ব্যতিক্রমী এক চ্যালেঞ্জ জয় করে প্রশংসায় ভাসছেন ভারতের কেরালা অঙ্গরাজ্যের ভিএস প্রিয়া। নিজেকে তৃতীয় লিঙ্গের নারী মনে করেন তিনি। তবে সমাজের অন্যান্য তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের চেয়ে একেবারে ভিন্ন একটি স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন তিনি। সম্প্রতি এই রাজ্যের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছেন প্রিয়া। তবে তার এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে পেরিয়েছেন সমাজের অনেক চ্যালেঞ্জ।
বিজ্ঞাপন
সেসব চ্যালেঞ্জের কথা সম্প্রতি দেশটির গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন ডা. ভিএস প্রিয়া। কেরালার এই চিকিৎসক বলেন, আমার স্বপ্ন অর্জনে আমার বাবা-মা পর্যাপ্ত সহায়তা করেছেন। বাবা-মা আমাকে শারীরিক এবং মানসিক— উভয় সমর্থন দিয়েছেন। যে কারণে আমি সবসময় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
আয়ুর্বেদিক এই চিকিৎসক পুরুষ হিসেবে জন্মালেও কৈশোরে পৌঁছানোর পর নিজের নারী স্বত্তা অনুভব করতে থাকেন। ভুল স্বত্তা নিয়ে বেড়ে উঠতে চাননি তিনি।
বিজ্ঞাপন
আমি জানতাম না তারা কীভাবে সংবাদটি গ্রহণ করবে। সেই সময় আমি যেটা করতাম সেটি হলো— আমার সমস্যাগুলো ডায়েরিতে লিখে রাখতাম; যাতে আমার পরিবারের সদস্যরা পরবর্তীতে দেখতে পান।
ডা. ভিএস প্রিয়া
নিজের নারী স্বত্তা অন্যদের বুঝাতে গিয়ে কী ধরনের সংগ্রাম করতে হয়েছে; সেবিষয়ে প্রিয়া বলেন, প্রথমে আমার বাবা-মা যেটি করলেন সেটি হলো তারা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। তারা মনে করেছিলেন— একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আমাকে সহায়তা করতে পারেন। চিকিৎসককে ধন্যবাদ। তিনি বললেন, আমার কোনও মানসিক সমস্যা নেই। কিন্তু ১৫ বছর বয়সে পৌঁছানোর পর বুঝতে পারলাম এই সমাজে আমার পরিচয় প্রকাশ করতে পারবো না। কারণ আমাকে নিয়ে উপহাস করা হবে।
স্কুলে বন্ধু-বান্ধব কিংবা শিক্ষকদের কাছে নিজের পরিচয় লুকানোও কষ্টকর হয়ে উঠেছিল প্রিয়ার। এতে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর অন্য শহরে যাওয়ার চিন্তা করলেন তিনি; যেখানে নারীর মতো বসবাস করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বাবা-মায়ের এতো ভালোবাসা পেয়েছিলেন যে, তাদের ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারছিলেন না।
প্রিয়া বলেন, আমার বাবা-মা দু’জনই নার্স। তারা চেয়েছিলেন— আমার ভাই এবং আমি যেন চিকিৎসক হই। আমার ভাই এমবিবিএস শেষ করে বর্তমানে বেঙ্গালুুরুর একটি হাসপাতালে কাজ করছেন।
আমি শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের আশা পূরণ করার জন্য চিকিৎসক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার পর ২০১৩ সালে ত্রিসুরের ওল্লুরের বিদ্যারত্ম আয়ুর্বেদিক কলেজে ভর্তি হন প্রিয়া। তিনি বলেন, একজন পুরুষ হিসেবে আমি এই কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব আয়ুর্বেদ, মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি (বিএএমএস) সম্পন্ন করেছি। বিয়ে নিয়ে মানুষের প্রশ্ন এড়াতে আমি পরবর্তীতে মেঙ্গালুরু থেকে মেডিসিন ডক্টর (এমডি) শেষ করেছি। এই কোর্স সম্পন্ন করার পর ত্রিপুনিথুরার সরকারি আয়ুর্বেদ মেডিক্যাল কলেজ এবং কান্নুরের সরকারি আয়ুর্বেদ কলেজ থেকে অতিথি প্রভাষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাই।
এই পুরো সময়ে নিজেকে একজন পুরুষের মতোই সমাজের কাছে তুলে ধরতে হয়েছে বলে জানান প্রিয়া। কিন্তু ২০১৮ সালে ত্রিসুরের সিতারাম আয়ুর্বেদ হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেয়ার পর সবকিছু বদলে যেতে থাকে। পেশাগত জীবনে ভালো করছেন এই চিকিৎসক। তার এই লড়াইয়ে বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আমার বাবা-মাও আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। আমার জীবন নিয়ে আমি খুশি। কিন্তু এখনও আমার স্বত্তা আমাকে তাড়া করে। পরে আমি বুঝতে পারি যে আমার বাবা-মাকে আমার স্বত্তা সম্পর্কে জানানো দরকার। আমি অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিই।
‘আমি লিঙ্গ পরিবর্তনের অস্ত্রোপচারের বিষয়ে জানতে গবেষণা করতে শুরু করি। পরবর্তীতে সত্যটাই আমার বাবা-মাকে জানাই। তারা হতবাক হওয়ার চেয়ে দুঃখটাই বেশি পেয়েছিলেন। আমি তাদের মনের কষ্ট বুঝতে পারি। কিন্তু সত্য প্রকাশ না করতে পারলে আমার নিজের প্রতি অবিচার হবে। তখন মনে হলো, এটি আমি করতে পারবো না। শেষ পর্যন্ত আমি গবেষণা করে বাবা-মাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম।’
সব শুনে বাবা-মা প্রিয়াকে দোষারোপের পরিবর্তে সমর্থন দেন। প্রিয়া বলেন, বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রোপচারের সময় হাসপাতালে আমার পাশে ছিলেন মা।
এখন পর্যন্ত প্রায় ছয়বার অস্ত্রোপচার করেছেন ডা. প্রিয়া। আরও দুটি বাকি রয়েছে— একটি কণ্ঠস্বরের এবং অন্যান্য কসমেটিক সার্জারির।
‘এক একবার অস্ত্রোপচার করতে কমপক্ষে তিন লাখ ভারতীয় রুপির দরকার হয়। তারপরও আমি চেয়েছিলাম যেন ভালোভাবেই আমার অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। তবে একবার বড় একটি অস্ত্রোপচারে আমার ৮ লাখ টাকার দরকার হয়। আমার জমানো টাকা থেকে সেটি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার বাবা-মা এই অস্ত্রোপচারের ৯৫ শতাংশ অর্থ দেন।’
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসছে বলে মন্তব্য করেন প্রিয়া। তিনি বলেন, ‘মানুষ এখন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের গ্রহণ করছে। তবে আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।’
নিজের নাম বদলানোর গল্প বলেন প্রিয়া। ডা. জিনু শশীধর নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। প্রিয়া বলেন, ‘এই নামটি নারী-পুরুষ উভয়েই ব্যবহার করে। কিন্তু আমি ভিন্ন কিছু চেয়েছিলাম। প্রথম দিকে আমি নিজেকে জোনাকি বলে পরিচয় দিতাম। কিন্তু আমার চাচাতো বোন প্রিয়া নামটি রাখার পরামর্শ দেন। যার অর্থ সকলের প্রিয়। যে কারণে আমি এই নামটি রেখেছি।’
সূত্র: দ্য বেটার ইন্ডিয়া, এশিয়া নেট নিউজ।
এসএস