প্রায় দু’মাস যাবৎ রাজধানী দিল্লির সীমানায় কৃষকদের ব্যাপক বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে দৃশ্যত কিছুটা পিছু হটে ভারতের কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন দেড় বছরের জন্য স্থগিতের প্রস্তাব করলেও তাতে সায় দেয়নি আন্দোলনরত কৃষক সংগঠনগুলো।

গত নভেম্বর থেকে দিল্লির সীমান্তবর্তী এলাকায় কৃষক আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এই তিন কৃষি আইন নিয়ে ১০ দফা বৈঠক হয়েছে কৃষক নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের। বুধবার হয় শেষ বৈঠকটি। সেখানে দেড় বছরের জন্য আইনগুলো কার্যকর করা হবে না বলে প্রস্তাব রেখেছিল কেন্দ্র।

এই প্রস্তাব সম্পর্কে বৃহস্পতিবার বৃস্পতিবার ভারতের কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমর সাংবাদিকদের জানান, কৃষি আইন দেড় বছরের জন্য মুলতবি করার প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে কৃষক সংগঠনগুলোর সামনে। প্রস্তাব অনুযায়ী একটি যৌথ কমিটি গঠন করা হবে। সেই কমিটি এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার আগ পর্যন্ত কৃষি আইন বলবৎ হবে না।

এদিকে বুধবারের বৈঠকে এই প্রস্তাবের জবাবে কৃষক নেতারা বলেছিলেন, বিষয়টি তারা বিবেচনা করে দেখবেন। সিপিএমের কৃষক নেতা ও এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক  হান্নান মোল্লা এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সংগঠনগুলি আলোচনায় বসেছে। তারা এখন সিদ্ধান্ত নেবে। সেই সিদ্ধান্ত সরকারকে জানানো হবে।'

এরপর বৃহস্পতিবার আন্দোলনরত কৃষক সংগঠনগুলোর ঐক্যমঞ্চ সংযুক্ত কৃষক মোর্চার নেতারা এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, সরকারের এই প্রস্তাব তারা মানছেন না। আইনগুলোর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং উৎপাদিত ফসলের ন্যূনততম সহায়ক মূল্য (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস-এমএসপি) নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কৃষকরা আন্দোলন চালিয়ে ‍যাবেন।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের আইনসভায় তিনটি কৃষি আইনসংক্রান্ত বিল উত্থাপন করা হয়। এরপর ২৭ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির সাক্ষরের মাধ্যমে আইনে পরিণত হয় বিল তিনটি।

আইন পাশের পরই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর কৃষক সংগঠনগুলো। আইন বাতিলের দাবিতে ২৬ নভেম্বর থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লির উপকণ্ঠে জড়ো হতে থাকেন লাখ লাখ কৃষক। ভারতের রাজধানীর সঙ্গে অন্যান্য প্রদেশ ও প্রাদেশিক শহরগুলোর সঙ্গে সংযোগকারী মহাসড়কগুলোতে প্রতিবাদী অবস্থান নেন তারা।

তাদের ক্ষোভের একটি বড় কারণ পাস করা আইন অনুযায়ী যে কোনো সময় এমএসপি, যা এতদিন ফসলের দাম নিশ্চিত করেছে তা প্রত্যাহার করে নিতে পারবে সরকার।

কৃষকদের আশঙ্কা, নতুন এ কৃষি সংস্কার আইনগুলো ভারতের নিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থাকে ভেঙে দেবে এবং সরকারও ধীরে ধীরে নির্ধারিত মূল্যে গম ও ধান কেনা বন্ধ করে দেবে; যার ফলে তাদেরকে ফসল বেচতে বেসরকারি ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষিতে নামতে হবে। যদিও স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব বলছে যে, এমএসপির সুবিধা সরানো হবে না, কৃষক সংগঠনগুলির মত, তবুও বাড়বে কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট হস্তক্ষেপ, যার ভূক্তভোগী হবেন ছোট চাষীরা।

কেন পিছু হটল বিজেপি

গত প্রায় দুই মাস ধরে কৃষকরা দিল্লির সীমানায় আন্দোলন করছেন। তাদের ঠেকাতে কম চেষ্টা করেনি মোদি সরকার। কৃষকদের দিল্লির সীমানায় আসতে বাধা দেয়া হয়েছে। জলকামান, লাঠিচার্জ হয়েছে; তাতেও কোনো লাভ হয়নি। কৃষকদের অভিযোগ, বিজেপি শাসিত রাজ্যে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে এ পর্যন্ত ৬০ জনের বেশি কৃষক হয় মারা গেছেন বা আত্মহত্যা করেছেন।

দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এ আন্দোলন ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামাঞ্চলে, যেসব এলাকায় কৃষিনির্ভর জনসমষ্টির বাস, সেসব স্থানে সমর্থন হারাচ্ছে বিজেপি৷ ভারতের একাধিক সংবাদ মাধ্যমে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

আবার ভারতে মোট জনসংখ্যার অধিকাংশই সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে আন্দোলনরত কৃষকদের তুলে দিতে খুব কঠোর ব্যবস্থাও নিতে পারেনি মোদি সরকার। অন্যদিকে কৃষকরা যে কী পরিমাণ ক্ষুব্ধ তা হরিয়ানা, পাঞ্জাবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় বোঝা গেছে। হরিয়ানায় কৃষকরা মুখ্যমন্ত্রীকে জনসভা পর্যন্ত করতে দেননি। পাঞ্জাবে একটি হোটেলে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিজেপির প্রয়াত নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ীর জন্মবার্ষিকী উদযাপনে গিয়ে কৃষক বিক্ষোভের মুখে পেছনের দরজা দিয়ে পালাতে বাধ্য হন বিজেপি নেতারা।  

ফলে কৃষকদের কাছে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিলেন মোদি, হারাচ্ছিল বিজেপি। তার ওপর কৃষকসংগঠনগুলো ২৬ জানুয়ারি ভারতের জাতীয় প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্রাক্টর মিছিল কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়ায় বিপাকে পড়ে বিজেপি। এ কর্মসূচির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে সুপ্রিম কোর্টে নালিশও জানানো হয় সরকারের পক্ষ থেকে; কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দেয়- এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে পুলিশ, আদালতের কিছু করার নেই।  

কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে- সরকার কোনোভাবেই চাইছে না, ২৬ জানুয়ারি কৃষকরা দিল্লির রাস্তায় ট্রাক্টর মিছিল করুক; কারণ সেক্ষেত্রে পুরো প্রচার তাদের দিকে চলে যাবে। তাই কৃষক বিক্ষোভ নিয়ে মোদি সরকার খুবই চাপে রয়েছে। শুক্রবার ফের কেন্দ্রের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে কৃষক সংগঠনগুলোর।

ভারতের ২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির প্রায় ১৫ শতাংশই কৃষির উপর নির্ভরশীল; দেশটির ১৩০ কোটি জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

সূত্র: আনন্দবাজার, ডিডব্লিউ

এসএমডব্লিউ