গত নভেম্বরের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করেছিল অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি)। কিন্তু ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী সেই নির্বাচনের ফল মেনে না নিয়ে কারচুপির অভিযোগ তোলার পর থেকে সামরিক অভ্যুত্থানের শঙ্কা জোরালো হতে শুরু করে।

সোমবার থেকে নবনির্বাচিত এনএলডি সরকারের প্রথম পার্লামেন্ট অধিবেশন বসার কথা। কিন্তু এদিন ভোরে কয়েকদিন ধরে আলোচিত অভ্যুত্থানের শঙ্কা অবশেষে সত্য হলো। সু চি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট গ্রেফতারের পর ক্ষমতা দখলে নিয়ে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছে সেনাবাহিনী।  

তবে সোমবার সকালে ঘুম ভেঙে মিয়ানমারের মানুষ যে খবরটি শুনতে পায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির জন্য তা নতুন নয়। দশ বছর আগে নির্বাচিত সরকার পাওয়ার পূর্বে বেশিরভাগ সময় দেশটি চলেছে স্বৈরশাসকদের অধীনে। গণতন্ত্রের আশায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিলেও এখনো তা অধরাই রয়ে গেছে।

মিয়ানমার থেকে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিনিধি ফ্লোরেন্স লুই বলছেন, ‘দেশটির সামরিক বাহিনী সর্বদা অস্বচ্ছ উপায়ে পরিচালিত হয়ে আসছে। নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবার জন্য অনেক ধরনের উপায় তৈরি করে রেখেছে তারা।’

স্বাধীনতার পর থেকে বেশিরভাগ সময় সামরিক শাসনের অধীনে থাকা মিয়ানমারের ক্ষমতার পথ-পরিক্রমার দিকে এক পলক চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। 

১৯৪৭ সালে বাবা অং সান এবং মা ও দুই বড় ভাইয়ের সাথে দুই বছর বয়সী অং সান সু চি।

১৯৪৭

জাপানের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং ব্রিটেনের কাছ থেকে দেশকে স্বাধীনতার পথে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়া মিয়ানমারের ‘জাতির জনক’ হিসেবে খ্যাত অং সানকে ওই বছর হত্যা করা হয়। অং সান সু চি তার একমাত্র কন্যা এবং কনিষ্ঠ সন্তান।

১৯৪৮

তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উ নু এর অধীনে ওই বছর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা অর্জন করে মিয়ানমার।

১৯৬২

জেনারেল নে উইনের অধীনে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। এরপর সব বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করে সেনাবাহিনী সমস্ত ব্যবসা এবং শিল্পের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সামরিক বাহিনীর অর্থনৈতিক নীতি ও ইচ্ছাকৃতভাবে দেশকে বিচ্ছিন্নকরণ অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।

১৯৬২ সালের প্রথম সেনা অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের ফলে দেশটিতে মারাত্মক রাজনৈতক দমনপীড়ন ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা তৈরি হয়।   

১৯৮৮

নাগরিক সমাজের হিসাব অনুযায়ী ওই বছরের আগস্টে গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভের দমনে নির্মম সামরিক অভিযানে প্রাণহানি ঘটে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে গুপ্তহত্যার শিকার মিয়ানমারের জাতির জনকের কন্যা অং সান সু চি ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৯০

আন্তর্জাতিক চাপে সামরিক বাহিনী ওই বছর নির্বাচন দিলে সু চির এনএলডি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয়। কিন্তু সামরিক বাহিনী ফল মেনে নেওয়া কিংবা ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। গ্রেপ্তারের পর গৃহবন্দি করে রাখা হয় অং সান সু চিকে। বন্দি অবস্থায় ১৯৯১ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পান। 

১৯৯৫

ওই বছরের জুলাইয়ে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হন এনএলডি নেত্রী অং সান সু চি। 

১৯৯৫ সালে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ইয়াঙ্গুনের বাসার সামনে অং সান সু চিকে ঘিরে ধরেছেন সাংবাদিকরা।

১৯৯৭

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট সাউথ ইস্ট এশিয়ান ন্যাশনস বা আশিয়ান জোটে যোগ দেয় মিয়ানমার। 

২০০০

মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চিকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়। এতে ইউরোপ মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরও জোরালো করে। 

২০০২

অং সান সু চিকে আবার বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান। তাকে এবার দেশের বাইরে যাওয়ারও অনুমতি দেওয়া হয়। 

২০০৩

আবারও গ্রেপ্তার হন অং সান সু চি। এবার অবশ্য তার সুরক্ষার কথা ভেবেই গ্রেপ্তারের কথা জানানো হয়। কারণ হিসেবে এর কিছুদিন আগে সু চির গাড়িবহরে হামলার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। 

যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার গোষ্ঠী ‘বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকে’র তথ্য অনুযায়ী ওই বছরের মে মাসে সামরিক বাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (ইউএসডিএ) নামের রাজনৈতিক মিলিশিয়া গোষ্ঠীর হামলার সময় সু চির ৭০ জনের বেশি সমর্থককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

পরে ইউএসডিএ নামের ওই মিলিশিয়া গোষ্ঠীর নাম বদলে ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে পার্লামেন্টে নির্ধারিত আসন দখলে নিতে শুরু করে সামরিক বাহিনী।

অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) ভোরে ক্ষমতা দখলে নেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং।

২০০৬

ওই বছর একপাক্ষিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে নেপিডোকে রাজধানী ঘোষণা করে সেনাবাহিনী। এটি একটি নতুন শহর; যা পূর্বের রাজধানী শহর ইয়াঙ্গুন এবং মান্দালয়ের মধ্যবর্তী স্থানে গোপনে তৈরি করা হয়েছিল। এর নেপথ্যে সেনাবাহিনীর নানান উদ্দেশ্য ছিল। 

২০০৭

সামরিক সরকার জ্বালানিতে ভর্তুকি দেওয়া বাতিল করার পরে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতৃত্বে দেশটির হাজার হাজার মানুষ ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করে। পরে সামরিক দমনাভিযানে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হয়।

২০০৮
বিতর্কিত এক সাংবিধানিক গণভোটের মাধ্যমে গণতন্ত্রকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইরাবতী ব-দ্বীপে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় নার্গিসের আঘাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হওয়ার মাত্র দুদিন পর এই ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

২০১০

এনএলডির বর্জন করা নির্বাচনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি জয় পায়। ওই বছরের নভেম্বরে গৃহবন্দি থেকে মুক্তি পান এনএলডি নেত্রী অং সান সু চি।

মিয়ানমারের মানুষের কাছে অং সান সু চি বেশ জনপ্রিয়।

২০১২

ওই বছর পশ্চিম রাখাইন রাজ্যে বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যে লড়াইয়ের ফলে কয়েক শতাধিক মানুষ নিহত হন। এছাড়া জাতিগত ওই লড়াইয়ে বাস্তুচ্যুত হয় দেশটিতে সংখ্যালঘু হিসেবে মারাত্মক বঞ্চনার শিকার হাজার হাজার রোহিঙ্গা ।

২০১৫

ওই বছরে দেশটির সাধারণ নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে। স্টেট কাউন্সিলর নামে বিশেষভাবে একটি পদ তৈরি করে সরকারপ্রধান হন অং সান সু চি।

২০১৬

বিদ্রোহী রোহিঙ্গারা সীমান্ত এলাকায় পুলিশের তিনটি চৌকিতে হামলা চালিয়ে নয়জন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করার পর রাখাইনে আবারও অস্থিতিশীলতা শুরু হয়। এরপর সামরিক বাহিনীর দমনাভিযানে প্রতিবেশী বাংলাদেশ ছাড়াও মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিতে শুরু করে।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ব্যাপকহারে হত্যা, ধর্ষণ ও নিধন অভিযানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। 

২০১৭

রাখাইনে সামরিক বাহিনীর নির্মম ও বর্বর রোহিঙ্গা নিধন অভিযানে ৭ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার ঢল নামে বাংলাদেশে। জাতিসংঘ তদন্ত করার পরে জানায় যে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ওই নিধন অভিযানে ‘গণহত্যার লক্ষ্যে’ ব্যাপকহারে হত্যা, ধর্ষণ ও রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল।

অবশ্য জাতিসংঘের ‘সত্যানুসন্ধান’ দলের এমন তদন্ত ফলাফল বরাবরই অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমান। এরপর এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদলতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা চলমান মামলার মোকাবিলার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি।

আরাকান আর্মি রাখাইনের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। 

২০১৯
বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াইরত আরাকান আর্মি (এএ) নামের একটি সশস্ত্র জাতিগত রাখাইন গোষ্ঠীর সঙ্গে রাখাইনে সরকারি সেনাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। মিয়ানমারের তৎকালীন নেত্রী সু চি ওই সময় এসব বিদ্রোহীকে ‘নির্মূল’ করে দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে আহ্বান জানিয়েছিলেন।

২০২০

করোনা মহামারির মধ্যেও গত বছরের নভেম্বরে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সু চির দল এনএলডি গত নির্বাচন অর্থাৎ ২০১৫ সালের নির্বাচনের চেয়েও বেশি ভোট ও বেশি আসন নিয়ে পুনরায় নির্বাচিত হয়।

কিন্ত সেনাবাহিনীর দল ইউএসডিপি কারচুপির অভিযোগ তুলে পুনরায় নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানায়। সামরিক বাহিনী আরও দাবি তোলে যে, পুনরায় নির্বাচনে সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করতে সামরিক বাহিনী এবার সহায়তা করবে।

মিয়ানমারের ক্ষমতাধর সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে অং সান সু চি। 

২০২১

২৬ জানুয়ারি: সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাও মিন তুন সতর্ক করে বলেন, নির্বাচনের বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে সশস্ত্র বাহিনী ‘পদক্ষেপ’ নেবে। তিনি নির্বাচন কমিশনকে ভোটার তালিকা নিয়ে তদন্ত করার আহ্বান জানান। সামরিক বাহিনীর দাবি, এই ভোটার তালিকায় গরমিল রয়েছে।

২৮ জানুয়ারি: নির্বাচন কমিশন ভোট জালিয়াতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলে যে, ভোটের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রভাবিত করার মতো কোনো ধরনের গরমিল হয়নি। ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। এতে বড় কোনও ত্রুটি ছিল না।

৩০ জানুয়ারি: অভ্যুত্থানের শঙ্কা দেখা দেওয়ার পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বিবৃতি দিয়ে জানায় যে, তারা দেশের সংবিধান রক্ষা করবে এবং মেনে চলবে। আর বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কাজ করবে তারা।

১ ফেব্রুয়ারি: সামরিক বাহিনী জানায়, ভোরে অভিযান চালিয়ে সু চি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করার পর সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের হাতে ক্ষমতা স্থানান্তর করা হয়েছে। ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কথা জানিয়ে এক বছরের জন্য দেশে জরুরি অবস্থা জারির কথাও জানানো হয়।

এএস