গরু পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) ৩ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। একই অভিযোগে বদলি করা হয়েছে আরও ১২ জনকে। কিন্তু এই শাস্তি দিতে কেন চার বছর সময় লাগল?

দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (সিবিআই) গত বছর থেকেই সীমান্ত অঞ্চলে গরু পাচার চক্রের সঙ্গে বিএসএফ কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়ে তদন্ত করছে। কিন্তু বিবিসি জানতে পেরেছে, অন্তত ৪ বছর আগেই বাহিনীর মহাপরিচালকে এ বিষয়টি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন এক কমান্ড্যান্ট। তারপরও এত বছরে কেন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, বাহিনীর ভেতরেই সেই প্রশ্নও উঠছে।

বিএসএফের কয়েকটি সূত্র বলছে, ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত ছিল। যাদের দায়িত্ব ছিল দুর্নীতি প্রতিরোধ করা, গরু পাচার চক্রে জড়িত ছিলেন সেই সব সিনিয়র অফিসারদের একাংশও। এদের মধ্যে কয়েক জনের নাম সামনে এসেছে, কিন্তু আরও অনেকেই জড়িত ছিলেন। তারা কেউ বিএসএফ থেকে অন্য কোনো বাহিনীতে চলে গেছেন, বা তাদের যেতে দেওয়া হয়েছে, কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।’

বিএসএফের পূর্ব কমান্ডের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিচালক পঙ্কজ কুমার সিং প্রকারান্তরে স্বীকারও করেছেন সেটা।

তিনি বলেন, ‘সৎ কর্মীদের থেকে অসৎদের পৃথক করতেই হবে আমাদের। কর্মচারী-কর্মকর্তদের ওপরে নজরদারি চালানোর জন্য যথেষ্ট কড়া ব্যবস্থা আছে। কোন অফিসার বা জওয়ান কাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে দুর্নীতি করছে সেটা আমরা জানতে পারবোই। সেই ব্যবস্থার মাধ্যমেই কিন্তু কর্মকর্তাদের একাংশের ব্যাপারে (গরু পাচারে জড়িত থাকার) তথ্য পাওয়া গেছে। আবার সিবিআই’ও আমাদের কিছু তথ্য দিয়েছে। যাদের ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাদেরই শাস্তি দেওয়া হয়েছে - বরখাস্ত করা হয়েছে।’

কিন্তু বাহিনীর অভ্যন্তরেই প্রশ্ন উঠছে গরু পাচারের সঙ্গে যে বিএসএফ কর্মকর্তাদের একাংশ জড়িত, সেটা তো ২০১৬ সালের পাঁচ জানুয়ারি মহাপরিচালককে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন রাজ কুমার বাসাট্টা নামে এক বিএসএফ কমান্ড্যান্ট। ওই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, দক্ষিণ বঙ্গ সীমান্তের হেডকোয়াটার্স থেকে শীর্ষ কর্মকর্তাদের নির্দেশ আসতো যে, কোম্পানি কমান্ডার এবং পোস্ট কমান্ডারেরা যেন পাচারকারীদের সঙ্গে গরু পাচারে সহযোগিতা করে।

এরকম নির্দিষ্ট অভিযোগ আসা সত্ত্বেও কেন তখন কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? বাহিনীর ভেতরেই তো নজরদারি বিভাগ আছে, সিনিয়র অফিসারেরা আছেন। তারা কেন চোখ বুজে ছিলেন?

এই প্রশ্নের উত্তরে পঙ্কজ কুমার সিং বলছিলেন, ‘এ বিষয়টা আমার জানা নেই, কারণ আমি বাহিনীতে যোগ দিয়েছি ২০২০ সালে। মহাপরিচালক যদি ২০১৬ সালে বিষয়টা জেনে থাকেন, নিশ্চয়ই তিনি কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, যেটা আমি জানি না।’

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে কাজ করে, এমন একটি মানবাধিকার সংস্থা মাসুমের প্রধান কিরিটি রায় বলছিলেন, তাদের কাছেও অনেক তথ্য প্রমাণ আছে যে বিএসএফের সহায়তা নিয়েই গরু-মানুষ-নিষিদ্ধ ড্রাগ পাচার হয় সীমান্ত দিয়ে। তার মতে, শীর্ষ অফিসারেরা জড়িত না থাকলে এটা (গরু পাচার) সম্ভব হতো না।

তিনি বলেন, ‘অজস্র প্রমাণ আমাদের হাতে আছে, যা থেকে স্পষ্ট যে, বিএসএফের একাংশের সহযোগিতা ছাড়া সীমান্তে কোনও কিছু পাচার হওয়া সম্ভব নয়। গোটা বাহিনীকে দোষ দেবো না, কিন্তু এক শ্রেণীর জওয়ান এবং অফিসার পাচার চক্রের সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই যুক্ত। এদের সঙ্গে স্থানীয় পুলিশ, রাজনৈতিক দলগুলোও থাকে। বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, এমন একজন তো দলীয় প্যাডে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংকে লিখেছিলেন যে, কীভাবে বিএসএফের মদতে সীমান্তে পাচার চলছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কতটা ব্যবস্থা নেওয়া হবে, বা তদন্তও কতদিন চলবে, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। এই পাচার চক্রের সঙ্গে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় স্তরের রাজনৈতিক নেতারাও জড়িয়ে আছেন।’

বিএসএফের সূত্রগুলো বলছে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ - এই পাঁচ বছরেই সবথেকে বেশি গরু পাচার হয়েছে দক্ষিণ বঙ্গ সীমান্ত দিয়ে। অথচ বিএসএফের পক্ষ থেকে সেসময় দাবি করা হয়, গরু পাচার বন্ধ করতে কঠোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেই সীমান্তে প্রচুর গরু আটক হচ্ছে।

২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত প্রতিবছরই এক থেকে দু’লাখ গরু আটক হয়েছে বলে দাবি করেছিল বিএসএফ। কিন্তু সীমান্তে গরু পাচারের ব্যাপারে জানেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, যত বেশি গরু আটক হবে, বুঝতে হবে ততই বেশি পাচার হচ্ছে। কারণ মোট পাচারের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ গরু বিএসএফ আটক করে।

তাহলে কি ওই সময় আসল তথ্য গোপন করার চেষ্টা করা হয়েছে? এই প্রশ্নের প্রতিক্রিয়ায় কিরিটি রায় বলেন, এভাবে ভুল তথ্য দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। যদিও সেই ‘ভুল তথ্যের’ ভিত্তিতেই ২০১৭-১৮ সালের জন্য ‘মহারাণা প্রতাপ ট্রফি’ অর্জন করে দক্ষিণ বঙ্গ সীমান্ত। সাধারণত এই পুরস্কার দেওয়া হয় ‘সেরা সীমান্ত ব্যবস্থাপনা’র জন্য।

আবার বিএসএফ অভ্যন্তরে এই প্রশ্নও উঠছে যে, যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বা যাদের সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে, তাদের বেশীরভাগই বিএসএফ ক্যাডার অফিসার। কিন্তু শীর্ষ পদগুলোতে ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস বা আইপিএস অফিসাররা তো ছিলেন - তাদের ভূমিকা কেন খতিয়ে দেখা হচ্ছে না?

সূত্র: বিবিসি বাংলা

টিএম