সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে ধর্মঘটে নামার পরিকল্পনা করছেন মিয়ানমারের চিকিৎসকরা। প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট, স্টেট কাউন্সিলার অং সান সু চিসহ শীর্ষ নেতাদের আটক ও সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদে দেশটির চিকিৎসকরা বুধবার (৩ ফেব্রুযারি) থেকে ধর্মঘটে নামছেন বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, সু চির মুক্তির দাবিতে বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি) থেকে কাজ বন্ধ করে দেবেন বলে জানিয়েছেন মিয়ানমারের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এমনকি সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে চাকরি থেকে পদত্যাগও করেছেন একজন চিকিৎসক।

পদত্যাগ করা ওই চিকিৎসকের নাম ড. নাইং তু অং। ৪৭ বছর বয়সী এই অ্যানেস্থেওলজিস্ট মিয়ানমারের সাগাইয়াং অঞ্চলের মংগুয়া হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমি এমন কোনো সামরিক শাসকের অধীনে চাকরি করতে পারবো না যারা দেশ ও দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে না। এ জন্যই আমি পদত্যাগ করেছি। পদত্যাগ করা মাধ্যমেই আমার জবাবটা তাদেরকে আমি দিয়েছি।’

মিও থেট ও নামে এক চিকিৎসক বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘সামরিক শাসক ও অনির্বাচিত কোনো সরকারকে আমরা মেনে নিতে পারি না।’ তিনি বলেন, ‘তারা (সামরিক বাহিনী) আমাদেরকে যেকোন সময় গ্রেপ্তার করতে পারে। আমরা সেটা মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। (সামরিক শাসনের প্রতিবাদে) হাসপাতালে কাজে না যাওয়ার ব্যাপারে আমরা সবাই একমত হয়েছি।’

সংবাদমাধ্যমটি বলছে, নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশটির সবচেয়ে বড় ও জনবহুল শহর ইয়াঙ্গুনের বাসিন্দারা তাদের হাড়ি-কড়াই ও বাসনে শব্দ করে এবং গাড়ির হর্ন বাজিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। তবে মানুষের মাঝে ক্ষোভ সত্ত্বেও সেনাবাহিনী দেশের নিয়ন্ত্রণ বেশ ভালোভাবেই নিয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসির সংবাদদাতারা।

এদিকে সামরিক অভ্যুত্থানের পর আটক হওয়া অং সান সু চির মুক্তি দিতে সারা বিশ্ব থেকে দাবি উঠেছে। স্টেট কাউন্সিলার ও দেশটির ডি ফ্যাক্টো এই নেত্রীকে আটক করার পর কোথায় রাখা হয়েছে তা এখনও জানা যায়নি। এছাড়া মিয়ানমারের পার্লামেন্টের প্রায় ৪০০ সদস্যকে রাজধানী নেপিদোর একটি উন্মুক্ত বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এপি।

বন্দি আইনপ্রণেতাদের একজন নামপ্রকাশ না করার শর্তে বার্তাসংস্থা এপি’কে জানান, তাকেসহ আরও প্রায় ৪০০ জন আইনপ্রণেতাকে রাজধানী নেপিদোর একটি হাউজিং কমপ্লেক্সে বন্দি করে রাখা হয়েছে। টেলিফোনের মাধ্যমে তারা একে-অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলেও ওই কমপ্লেক্স থেকে বাইরে বের হওয়ার অনুমতি তাদের দেওয়া হচ্ছে না। বন্দি থাকা আইনপ্রণেতাদের মধ্যে অং সান সু চি নেই বলেও জানান তিনি।

ওই আইনপ্রণেতা আরও জানান, সরকারি এই হাউজিং কমপ্লেক্সের ভেতরে পুলিশ এবং বাইরে সেনা সদস্যরা অবস্থান করছেন। এনএলডিসহ অন্য আরও বেশ কয়েকটি ছোট দল থেকে নির্বাচিত এসব আইনপ্রণেতা সামরিক অভ্যুত্থানের পর সারারাত নির্ঘুম ছিলেন। সেখান থেকে তাদেরকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হবে বলে আশঙ্কা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি।

গত বছরের নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সু চির দল এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু সেনাবাহিনী নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তোলে। সোমবার নব-নির্বাচিত সংসদের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল। সেই অধিবেশনে যোগদান করতেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ওই হাউজিং কমপ্লেক্সে এসেছিলেন এসব আইনপ্রণেতা।

নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে স্থানীয় সময় সোমবার ভোরে সামরিক অভ্যুত্থান করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এরপর স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি’র সরকারকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট, অং সান সু চিসহ আটক করা হয় অনেক শীর্ষ নেতাকে। এছাড়া একযোগে ২৪ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকেও অপসারণ করে অভ্যুত্থানকারীরা। গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি)।

গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে এবং আটককৃত সকল নেতাকর্মীকে মুক্তি দিতে এক বিবৃতিতে মঙ্গলবার সামরিক বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এনএলডি। নিজেদের ফেসবুক পেইজে দেওয়া ওই বিবৃতিতে এনএলডি জানায়, ‘সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাপ্রধানের ক্ষমতাগ্রহণ সংবিধান পরিপন্থী এবং এটা জনগণের সার্বভৌম অধিকারের বিরোধী।’

অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। দেশের সব বড় বড় শহরে টহল দিচ্ছে সেনা সদস্যরা। এছাড়া সারা দেশে রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করা হয়েছে। নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার পর টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও মঙ্গলবার সকালে তা সীমিত আকারে চালু হয়।

বিবিসি বলছে, সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে মঙ্গলবার (২ ফেব্রুয়ারি) রাতে ইয়াঙ্গুনের প্রতিটি সড়কের বাসিন্দারা তাদের ঘর থেকেই হাড়ি-কড়াই ও বাসনে শব্দ করতে থাকেন এবং অনেকে রাস্তা থেকে গাড়ির হর্ন বাজিয়ে সেই প্রতিবাদে শামিল হন।

এছাড়া বিভিন্ন যুব ও ছাত্র সংগঠন সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং তাদের এই প্রচারণায় এক লাখেরও বেশি মানুষ ‘লাইক’ দিয়েছেন। 

দেশটির সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ শহর ইয়াঙ্গুন থেকে বিবিসির সংবাদদাতারা জানিয়েছেন, অভ্যুত্থানের পর বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং শহরটির আশেপাশের এলাকাগুলোর সঙ্গে সড়ক যোগাযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে কড়া নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হয়েছে।

এদিকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর নির্বাচন কমিশন ঢেলে সাজিয়েছে সামরিক বাহিনী। একইসঙ্গে দেশটির পুলিশ বাহিনীর প্রধান হিসেবেও নতুন একজনকে নিয়োগ করা হয়েছে। গত নভেম্বরের নির্বাচনে সেনাবাহিনী কারচুপির অভিযোগ করলেও সদ্য বিদায় নেওয়া ওই কমিশন তা অস্বীকার করেছিল।

সূত্র: বিবিসি

টিএম