আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলছে আফগান ‘স্টিকি বোমা’
গজনী শহরের সেনা চৌকিতে সতর্কাবস্থায় আফগান সামরিক বাহিনীর সদস্যরা
যানবাহনের নিচে স্থাপন করা এক ধরনের ছোট, চৌম্বকীয় বোমা বিস্ফোরণে কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আফগানিস্তানের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক কর্মী এবং সাংবাদিকদের সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। বোমা হামলা চালিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য তালেবান গোষ্ঠীকে দায়ী করেছেন তারা।
এমন এক সময়ে হামলার ঘটনাগুলো ঘটছে; যখন আফগানিস্তানে দুই দশকের গৃহযুদ্ধ অবসানে সরকার ও তালেবান প্রতিনিধিদের মধ্যে শান্তি আলোচনা চলমান রয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহে ‘স্টিকি বোমা’ হামলার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের সহকারী। অধিকাংশ হামলার ঘটনা ঘটেছে রাজধানী কাবুলে।
বিজ্ঞাপন
আফগানিস্তানের সমরকৌশলবিদ, জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবং বিদেশি কূটনীতিকদের ভাষ্য, জনমনে একটু একটু করে আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলতে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের ঘটনা ঘটানোর চেয়ে ‘স্টিকি বোমা’ হামলাকে অধিকতর কার্যকর মনে করছে তালেবান।
আফগানিস্তানে দায়িত্বপালনরত একজন জ্যেষ্ঠ পশ্চিমা কূটনীতিক বলেছেন, হামলার মূল লক্ষ্য তালেবান চিন্তাধারার বিরোধী মাঝারি পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা।
বিজ্ঞাপন
‘আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, দেশটির মধ্যম পর্যায়ের এবং উচ্চাভিলাষী সরকারি কর্মকর্তা, যারা স্পষ্টভাবে তালেবান চিন্তাধারাবিরোধী, তাদের নির্মূল করতেই এই ধরনের (স্টিকি বোমা) হামলা চালানো হচ্ছে’।
সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কূটনীতিক আরও বলেন, ‘হামলাকারীরা সরকারের উচ্চপর্যায়ের কোনও কর্মকর্তাকে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকছে, কারণ এমন হলে তা দেশজুড়ে যে বড় ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা সামাল দেয়ার মত শক্তি এই মুহূর্তে তাদের নেই। এছাড়া উচ্চপর্যায়ের কোনও কর্মকর্তা হামলার শিকার হলে চলমান শান্তি আলোচনা ভেস্তে যেতে পারে- এমন শঙ্কাও রয়েছে তালেবানের’।
সম্প্রতি তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ কয়েক সপ্তাহজুড়ে ঘটে যাওয়া কয়েকটি হামলার দায় স্বীকার করে বলেন, তারা শুধুমাত্র সেই সব সরকারি কর্মকর্তাকে ‘টার্গেট’ করেছেন; যারা একই সঙ্গে তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন এবং শান্তি আলোচনার নামে ‘ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত রয়েছেন।
‘যুদ্ধক্ষেত্রে যারা আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং শান্তি আলোচনার নামে যারা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত; সেই সব সরকারি কর্মকর্তারাই আমাদের প্রধান শত্রু। আমরা তাদের শনাক্ত এবং নির্মূল করার কাজ করে যাবো। তবে সাংবাদিক কিংবা সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি আমাদের কোনও ক্ষোভ নেই’— বলেন তিনি।
দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সম্প্রতি সময়ে ঘটে যাওয়া হামলাগুলোর জন্য তালেবানকে দায়ী করেছে। কাবুলের আটজন জেষ্ঠ্য আফগান সরকারি কর্মকর্তা, তিনজন স্থানীয় সাংবাদিক এবং দু’জন নারী অধ্যাপক রয়টার্সকে বলেছেন, তারা নিজেদের যানবাহন পরিবর্তন করেছেন এবং পূর্বে যে পথ দিয়ে কর্মস্থলে যাতায়াত করতেন; তা পরিবর্তন করে অন্য পথ ব্যবহার করছেন।
কাতারের রাজধানী দোহায় শুরু হওয়া শান্তি আলোচনা, বিভিন্ন পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ার কারণে যা শুরু করতে সময় লেগেছে তিন মাস, তাতে বিরতির পর থেকে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে রয়েছেন তালেবানের শীর্ষ নেতারা। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের পর থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে শান্তি সংলাপ যে আশার আলো জ্বালিয়েছিল, তাকে ক্রমশ ম্লান করে দিচ্ছে ক্রমবর্ধমান এই সহিংসতা।
‘সংলাপ চলমান সত্ত্বেও, নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যাপকমাত্রায় আতঙ্ক ছড়ানোর যে লক্ষ্য নিয়েছে জঙ্গিরা, তাতে তারা সফল’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পশ্চিমা কূটনীতিক
দেশটির কয়েকটি প্রদেশে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর জন্য সরকারের সব বাহিনীর বিরুদ্ধে বড় ধরনের আঘাতের পরিকল্পনাও জঙ্গিরা নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং নোংরা
আফগানিস্তানের এই মারণঘাতী অস্ত্র ‘স্টিকি বোমা’র বিস্ফোরণ ঘটাতে ব্যবহৃত হয় রিমোট কন্ট্রোল অথবা টাইম ডিলে ফিউজ। একটি গাড়ি উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে এই বোমার। যুদ্ধের শুরুর দিকের বছরগুলোতে স্থানীয় ও প্রবাসী আফগান, যারা দেশের নড়বড়ে গণতন্ত্র ও অর্থনীতি রক্ষার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন– তাদের ভীতি প্রদর্শনের জন্য এই বোমা ব্যবহার করা হতো।
বোমাটি দেখতে আধুনিক যুগের অন্যান্য বোমার মতো পরিশীলিত নয়, তবে এটি সহজলভ্য, কার্যকরী এবং গাড়িতে লাগানো হলে শনাক্ত করা কঠিন।
সাম্প্রতিক হামলার ঘটনার পর যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন, তাদের ‘টার্গেটেড’ গাড়িগুলো যখন ট্রাফিক সিগন্যালের কারণে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অথবা থেমে থাকে; তখন তারা মোটরবাইকে করে বা পায়ে হেঁটে সেই গাড়ির কাছে পৌঁছে বোমা লাগিয়ে আসতেন।
আফগানিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী সংস্থা জাতীয় নিরাপত্তা অধিদফতরের মুখপাত্র রহমতউল্লাহ আন্দার বলেন, ‘গাড়িতে চৌম্বকীয় স্টিকি বোমা লাগাতে বেশিরভাগক্ষেত্রেই কিশোর তরুণদের কাজে লাগানো হয়। অনেক সময় সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে তারা এ কাজ করে’।
যদিও এখন পর্যন্ত অনেকটা বিক্ষিপ্তভাবেই হচ্ছে ‘স্টিকি বোমা’ হামলা। তবে হামলার এই ঘটনাগুলো মানসিকভাবে একধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করে বলে জানিয়েছেন রহমতউল্লাহ আন্দার।
‘প্রতিদিন সকালে নাশতার পর আমি কয়েক মিনিট চিন্তা করি, আমার আসলে কী করা উচিত– কাজ করা নাকি নিজের বেঁচে থাকা নিশ্চিতের চেষ্টা করা। আতঙ্ক ক্রমশ বাড়ছে।’
সূত্র: রয়টার্স।
এসএমডব্লিউ/এসএস