মিয়ানমার: ইন্টারনেট বন্ধ করেও থামানো যাচ্ছে না বিক্ষোভ
সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদ ও দেশটির ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চির মুক্তির দাবিতে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো রাস্তায় নেমেছে মিয়ানমারের লাখো মানুষ। শনিবারের বিক্ষোভের ধারবাহিকতায় রোববারও (৭ ফেব্রুয়ারি) দেশটি প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনে রাস্তায় নামে বিক্ষুব্ধরা। মূলত অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে মানুষের অংশ নেওয়া ঠেকাতে জান্তা সরকার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিলেও তা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, রোববারের বিক্ষোভে অংশ নিয়ে মানুষ ‘আমরা সামরিক একনায়কতন্ত্র চাই না’ স্লোগান দিচ্ছেন। তাদের অনেকে অং সান সু চির ছবি নিয়ে এবং লাল রংয়ের পোশাক পরে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। লাল রং হচ্ছে সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) দলীয় রং।
বিজ্ঞাপন
এর আগে সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ জোরদার হওয়ায় শনিবার মিয়ানমারে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয় দেশটির জান্তা সরকার। শনিবার ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষের অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভের পর এই সিদ্ধান্ত নেয় সামরিক সরকার। এর আগে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম এবং টুইটারসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও শনিবারের বিক্ষোভের বেশ কয়েকটি ছবি অন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ পায়।
বিজ্ঞাপন
এদিকে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, অং সান সু চির মুক্তির দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় নেমেছে লাখ লাখ মানুষ। তারা সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) দলীয় রং- লাল রংয়ের বেলুন হাতে নিয়ে ‘আমরা সামরিক শাসন চাই না! আমরা গণতন্ত্র চাই!’ স্লোগান দেন।
এসময় অনেকের হাতে এনএলডি’র পতাকা এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে ‘তিনটি আঙুল’ দেখিয়ে প্রতিবাদ জানান। অনেকের হাতে সু চির ছবিও রয়েছে।
রোববার ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় বিক্ষোভে নামা মিও উইন নামে ৩৭ বছর বয়সী এক বিক্ষোভকারী বার্তাসংস্থা এএফপি’কে বলেন, ‘গণতন্ত্র ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন করতে থাকবো। আমরা সামনে এগিয়ে যাবো।’
বিবিসি জানিয়েছে, বিক্ষোভ ঠেকাতে ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে সেখানে কোনো সহিংসতা হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। এছাড়া মওয়ালামাইন ও মান্দালাই শহরেও রোববার সকালে ছোট আকারে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। দেশটির ডি ফ্যাক্টো নেত্রী ও সাবেক স্টেট কাউন্সিলার অং সান সু চি এবং প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট এখনও গৃহবন্দি রয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত তাদের দেখা যায়নি।
গত নভেম্বরের নির্বাচনে এনএলডি’র বিশাল জয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বিক্ষোভস্থলে থাকা একটি ব্যানারে লেখা; ‘আমাদের ভোটকে সম্মান দেখাও!’
বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিনিধি জোনাথন হেড জানিয়েছেন, ‘বিক্ষোভ দমনে কঠোর নীতি ও কু-কৌশল অনুসরণের জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পরিচিতি থাকলেও ইন্টারনেট বন্ধ করা ছাড়া তারা এখন পর্যন্ত এই গণবিক্ষোভের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তবে সবার ধারণা, খুব বেশি দেরি হওয়ার আগেই বিক্ষোভ দমনে ব্যবস্থা নেবে সামরিক বাহনী।’
বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ২০০৭ সালে তথাকথিত জাফরান বিপ্লব’র পর রোববারের বিক্ষোভেই সবচেয়ে বেশি মানুষ অংশ নিয়েছে। প্রায় ১৪ বছর আগের সেই বিক্ষোভও হয়েছিল তৎকালীন সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে।
সেসময় জ্বালানি তেলের নাটকীয় মূল্য বৃদ্ধির পর দেশজুড়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে মানুষ। বৌদ্ধ সন্নাসীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া সেই বিক্ষোভকে বলা হয়েছিল ‘জাফরান বিপ্লব’। সু চি এই বিক্ষোভকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। পরে সামরিক সরকার অবশ্য কঠোর হাতে সেই বিক্ষোভ দমন করে।
তবে সর্বশেষ সেনা অভ্যুত্থানের পর সৃষ্ট জনবিক্ষোভ সম্পর্কে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি মিয়ানমারের সামরিক সরকার। বিবিসি বলছে, শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা রাজধানী নেপিদোতে অবস্থান করছেন। তারা এখনও পর্যন্ত বিক্ষোভকারীদের মুখোমুখি হওয়া থেকে নিজেদেরকে বিরত রেখেছেন।
এদিকে বিক্ষোভ দমাতে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। যত দ্রুত সম্ভব এই সেবা ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা। দেশটির সামরিক সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ‘জঘন্য ও বেপরোয়া’ বলে অভিহিত করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ইন্টারনেট বন্ধের কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত থমাস অ্যান্ড্রুস বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করছে সামরিক কর্মকর্তারা। আর ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করার মাধ্যমে এসব ঘটনা বাকি বিশ্ব থেকে আড়াল করতে চায় তারা।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে সু চির দল ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও দেশটির প্রভাবশালী সামরিক বাহিনী নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে গত ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে নেয়।
সূত্র: বিবিসি
টিএম