গত বছরের বইমেলার প্রস্তুতির ছবি

আগামী ১৮ মার্চ থেকে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। এতে অংশ নিতে ইতিমধ্যেই সাড়ে ৫ শতাধিক প্রতিষ্ঠান টাকা জমা দিয়েছে। আর এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্টল বরাদ্দের লটারি হবে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে। লটারি শেষে একযোগে স্টল তৈরি এবং সাজসজ্জার কাজ শুরু হবে।

তবে, প্রকাশকদের আশঙ্কা-এবারের মেলায় গত বছরের চাইতে অনেক কম নতুন বই প্রকাশিত হবে, বিক্রিও কমবে। করোনা মহামারির কারণে মধ্যবিত্তের আয় কমেছে, অন্যদিকে প্রকাশনী সংস্থাগুলোও এবার ঝুঁকি নিয়ে অর্থ লগ্নি করে বেশি বই প্রকাশ করবে না।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতবারের তুলনায় এবার মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনী সংস্থা কিছুটা কমবে। তবে, সেটা খুব বেশি নয়। পুরাতন কিছু প্রকাশনী সংস্থা এবারের মেলায় অংশ নিচ্ছে না। অন্যদিকে, নতুন কিছু সংস্থা অংশ নিতে আবেদন করেছে। ফলে সব মিলিয়ে সাড়ে ৫শ প্রতিষ্ঠান এবারের মেলায় অংশ নেবে। ইতিমধ্যে মেলার নকশা ও ম্যাপ তৈরি কাজ শুরু হয়েছে।

মার্চের প্রথম সপ্তাহে মেলার স্টল বরাদ্দের লটারি হবে বলে উল্লেখ করে ড. জালাল আহমেদ বলেন, এটার তারিখ নির্দিষ্ট করে এখনও চূড়ান্ত করতে পারিনি। তবে, মার্চের প্রথম সপ্তাহে লটারি হবে। এরপর প্রকাশকরা স্টল তৈরির কাজ শুরু করতে পারবেন।

এদিকে প্রকাশনী সংস্থাগুলো বলেছেন, করোনা মহামারীতে তারা বিশাল ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এ আর্থিক ক্ষতির অংকটা ছিলো ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকার মতো। ফলে, কেউ খুব বেশি ঝুঁকি নিয়ে নতুন বই প্রকাশ করতে আগ্রহী নয়। অন্যদিকে, করোনায় মানুষের আয়ও কমে গেছে। বিশেষ করে, বই মেলায় ক্রেতার বিশাল অংশ ছিলো মধ্যবিত্ত। করোনায় কাজ হারিয়ে সে মধ্যবিত্তের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। আর নিম্ন মধ্যবিত্তের অবস্থা তো আরও খারাপ। সব মিলিয়ে এবারের মেলায় বই বিক্রি অনেক কম হবে।

আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার কারণে প্রকাশনী ব্যবসা একেবারেই বন্ধ ছিলো। এ সময় বিশাল ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রকাশকরা। ফলে, এখন প্রকাশকদের হাতে খুব বেশি অর্থ নেই। তাই কেউ ঝুঁকি নিয়ে নতুন বই প্রকাশ করতে আগ্রহী নয়। গত বছর মেলায় আগামী প্রকাশনী ১২০টি নতুন বই প্রকাশ করেছিলো। এবার আমাদের সব মিলিয়ে শতাধিকের মতো নতুন বই প্রকাশ হবে। তার মানে হলো, ২০ টির বেশি নতুন বই প্রকাশ কমেছে আমাদের। এই রকম সব প্রকাশনীর নতুন বই প্রকাশ কমবে।

তিনি আরও বলেন, বই প্রকাশ করলে তো হবে না, বিক্রিও করতে হবে। এখন মেলায় বইয়ের ক্রেতা কারা? দেশের বড়লোক এবং নিম্ন আয়ের মানুষ খুব বেশি বই ক্রয় করে না। মেলায় ক্রেতার বড় অংশ হচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিবার। এ করোনায় অনেক মধ্যবিত্ত কাজ হারিয়েছে, অনেকের ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার খবর আমরা দেখেছি। ফলে, গত বছর মেলায় ৮২ কোটি বই বিক্রি হলোও এবার মেলায় সেটা ৫০ কোটি হয় কি-না সন্দেহ আছে।

অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবার মেলার সময় এমনিতে পিছিয়ে গেছে। এ সময়টায় বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। ফলে, করোনা মহামারির সঙ্গে যুক্ত হবে বৃষ্টি। মেলায় কমবে দর্শনার্থী। করোনায় মানুষের আয় কমার পাশাপাশি বৃষ্টির কারণে দর্শনার্থী কমলে স্বাভাবিকভাবে মেলায় বিক্রি কমে যাবে এটাই স্বাভাবিক। এসব কিছু মাথায় রেখেই প্রকাশকদের এবার নতুন বই প্রকাশ করতে হচ্ছে।

গত বছর মেলায় অংশ নিলেও এবার অংশ নিচ্ছে না প্রকৃতি প্রকাশনী। সংস্থাটির স্বত্বাধিকারী সৈকত হাবিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার প্রকাশনী ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ হয়েছে। গত বছর মেলায় অংশ নিলোও এবার আমরা অংশ নিচ্ছি না। এটা হলো আমার প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত। আরেকটা কথা হচ্ছে, মানুষের হাতে এখন খুব বেশি টাকা পয়সা নেই, ফলে কতটা বই বিক্রি হবে বা ব্যবসায়ীরা কতটা লাভবান হবে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। মানুষের মধ্যে খুব বেশি আনন্দ, ফুর্তি হবে না। কারণ জাতীয়ভাবেই অর্থনৈতিক সংকট চলছে। বই তো কিনে সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্নবর্তীরা। করোনায় তাদের হাতে খুব বেশি টাকা পাওয়াও নেই। ফলে, প্রকাশকদের আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গণসংহতি প্রকাশনীর দিপক রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত মেলায় তাদের ৩০টির মত নতুন বই এবং অনুবাদ প্রকাশ হয়েছিলো। এবার মেলা সেটাই ১০ থেকে ১৫টির মতো হতে পারে। কারণ বই প্রকাশ করার পাশাপাশি বিক্রির বাজার কতটুকু আছে, সেটাও বিবেচনা নিতে হয়।

প্রকাশনায় প্রাধান্য পাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকীর প্রভাব পড়ছে এবারের বই মেলায়। এবারের মেলায় নতুন বইয় প্রকাশের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখা প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। প্রকাশনী সংস্থাগুলো বলছে, আগামী মার্চ মাসে শুরু হবে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। আর ইতিমধ্যে পালন হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী। ফলে, এবারের মেলায় দুইটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েই লেখকরা লিখছেন। আর প্রকাশকরাও  মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখা বই প্রকাশে আগ্রহী।

আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি বলেন, স্বাভাবিকভাবে এবারে মেলায় মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু ওপর লেখাকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন বই প্রকাশ হচ্ছে। গল্প, কবিতা এবং প্রবন্ধের চাইতে পাশাপাশি এবার মানুষের জানার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু। আগামী প্রকাশনীর প্রকাশিত নতুন বই আমরা এ দুইটি বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছি।

অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে এবারের মেলায় আমাদের ১০০টি নতুন বই থাকবে। যেখানে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধকে।

এদিকে এবারের মেলায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমিও ১০০টি বই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। এরমধ্যে ২৭টি বই প্রকাশ হয়েছে। এবারের মেলায় ১০টির অধিক বই প্রকাশ করারও কথা বলছে সংস্থাটি।

প্রসঙ্গত, আগামী ১৮ মার্চ থেকে শুরু হয়ে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে এবারের একুশে বইমেলা। বাংলা একাডেমির তথ্য মতে, অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২০ এ ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। নতুন বই প্রকাশিত হয়েছিল ৪ হাজার ৯১৯টি। এগুলোর মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছিল ৪১টি নতুন বই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি অংশে সব মিলিয়ে ৫৬০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৭৩টি ইউনিট বা স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।

এএইচআর/এমএইচএস